শারদীয়া দুর্গাপূজাকে ‘মহাপূজা’ নামে অভিহিত করা হয়। কারণ মহাস্নান, পূজা, হোম ও বলিদান—এই চারটি কর্মের সমন্বয়ে মহাপূজা সিদ্ধ হয় এবং এই চারটি কর্মের অনুষ্ঠানই দুর্গাপূজার আবশ্যিক অঙ্গ। লিঙ্গপুরাণ-এ আছে—“শারদীয়া মহাপূজা চতুঃকর্মময়ী শুভা।
তাং তিথিত্রয়মাসাদ্য কুর্যাদ্ভক্ত্যা বিধানতঃ॥”১
এই প্রবন্ধে আমরা মহাস্নান প্রসঙ্গে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
দেবীভাগবত ভগবান বেদব্যাসের অমৃতময়ী লেখনী-প্রসূত অন্যতম উপপুরাণ। পরমেশ্বরকে মাতৃভাবে উপাসনা করে কীভাবে মুক্তিলাভ করা যায় এবং ঐ সাধনায় কীভাবে একনিষ্ঠ হতে হয় তা এই পুরাণে সুবিস্তৃতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর একাদশ স্কন্ধের অষ্টাদশ অধ্যায়ে দেবীকে নানা উপচারে স্নান করানোর ফল ও মহিমা সম্পর্কে বলা হয়েছে—
স্নাপয়েৎ পরদেবীং তাং পঞ্চামৃতরসাদিভিঃ॥
পৌণ্ড্রেক্ষুরসপূর্ণৈস্তু কলসৈঃ শতসংখ্যকৈঃ।
স্নাপয়েদ্ যো মহেশানীং ন স ভূয়োঽভিজায়তে॥”
—এরপর পঞ্চামৃতরস দিয়ে পরমা দেবীকে স্নান করাবে। যিনি ইক্ষুরসপূর্ণ শতসংখ্যক কলস দ্বারা দেবীকে স্নান করান, তাঁর পুনর্জন্ম হয় না।
ঐ অধ্যায়ে আরো বলা হয়েছে—যিনি বেদমন্ত্র পাঠ করতে করতে আমের রস বা আখের রস দিয়ে জগদীশ্বরীকে স্নান করান, লক্ষ্মী-সরস্বতী কখনো তাঁর গৃহ ত্যাগ করে যান না। যিনি বেদমন্ত্র পাঠ করতে করতে আঙুররস দিয়ে মহেশ্বরীকে অভিষেক করান, তিনি নরশ্রেষ্ঠ এবং সেই আঙুররসের রেণুসংখ্যাপরিমিত বছর (অর্থাৎ অনন্ত কাল) দেবীলোকে সুখে বাস করেন। যিনি বেদমন্ত্র পাঠ করতে করতে কর্পূর, অগুরু ও কস্তুরীমিশ্রিত জল দিয়ে দেবীকে স্নান করান, তাঁর শতজন্মের পাপ ভস্মীভূত হয়। যিনি বেদমন্ত্র পাঠ করতে করতে কলসিপূর্ণ দুধে দেবীকে স্নান করান, তিনি সেই কল্পে ক্ষীরসাগরে বাস করেন (অর্থাৎ, অনন্ত সুখের অধিকারী হন)। যিনি দই দিয়ে দেবীর অভিষেক করান, তিনি দধিকুল্যার এবং যিনি মধু, ঘৃত অথবা শর্করা-মিশ্রিত জলে দেবীকে স্নান করান, তিনি মধুকুল্যার অধিপতি হন। যিনি সহস্রসংখ্যক কলসের জলে ভক্তিভাবে দেবীকে স্নান করান, তিনি ইহলোকে সুখভোগ করে পরলোকেও সুখী হন—‘ইহ লোকে সুখী ভূত্বাপ্যন্যলোকে সুখী ভবেৎ’।২ বেদের শতপথ ব্রাহ্মণের একাদশতম কাণ্ডের তৃতীয় প্রপাঠকের অষ্টম ব্রাহ্মণে উল্লিখিত মন্ত্রের সায়নভাষ্য অনুসারে ‘কুল্যা’ শব্দের অর্থ সরিৎ বা নদী।৩ অতএব মধুকুল্যা ও দধিকুল্যার অর্থ মধুনদী বা দধিনদী। এর দ্বারা ইহলোক তথা পরলোকের অপরিমিত অনন্ত ঐশ্বর্যের নানা স্তরের অধিপতি অর্থাৎ ভিন্ন ভিন্ন লোক বা ভোগভূমির অধিপতি—এইরকম বুঝতে হবে।
পূজাবিজ্ঞানের মোটামুটিভাবে সর্বসম্মত সংকলনগ্রন্থ ক্রিয়াকাণ্ডবারিধিতে বর্ণিত বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণোক্ত দুর্গাপূজার বিধিব্যবস্থা অনুসারে সপ্তমীপূজার দিন ভোরবেলা শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে নবপত্রিকাস্নানের পর দেবীর মহাস্নানপর্ব শুরু হয়।৪ সপ্তমী ছাড়াও মহাষ্টমী ও মহানবমী তিথিতেও দেবীপূজার আগে সপ্তমীপূজার মহাস্নানের নিয়মে যথাবিহিত দেবীর মহাস্নান সম্পন্ন করতে হয়। নানা দ্রব্যসম্ভারে বাদ্যোদ্যম সহকারে অপূর্ব ভাবোদ্দীপক মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে হাঁড়ি বা তাম্রপাত্রে দর্পণ স্থাপন করে ঐ দর্পণে প্রতিবিম্বিত দেবীকে বিশেষভাবে চিন্তা করতে করতে মহাস্নান সম্পন্ন করতে হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, মহাস্নানের সময় কুমারী ও সাধ্বী স্ত্রীকুলের উলুধ্বনিও মহাস্নানের অনুভববেদ্য মহিমাকে শতগুণে বাড়িয়ে তোলে। মৎস্যসূক্তে আছে—
“স্নাপয়েৎ শঙ্খতোয়েন প্রতিমায়াঞ্চ দর্পণে।…
কুমারীণাঞ্চ সাধ্বীনাং শ্রাবয়েচ্চ তথা ধ্বনিম্।…
মহোৎসবে চ মাঙ্গল্যে তত্র স্ত্রীণাং ধ্বনিঃ শুভঃ।”৫
মহাস্নান কৃত্যের শুরুর দিকে মহাদেবীর অনুমতি প্রার্থনা করে বলতে হয়—
“ওঁ আজ্ঞাপয় মহাদেবি স্নানার্থং পরমেশ্বরি।
আদর্শে স্নাপয়ামি ত্বাং নানাদ্রব্যৈঃ স্বশক্তিতঃ॥”
—হে মহাদেবি, হে পরমেশ্বরি (সামনে রাখা এই) আদর্শে অর্থাৎ দর্পণে (প্রতিবিম্বিত) তোমাকে আমার সাধ্যমতো নানা দ্রব্য দিয়ে স্নান করানোর অনুমতি দাও।
এখন একটা প্রশ্ন উঠতে পারে যে, দর্পণে দেবীকে স্নান করানোর কারণ কী? প্রথম কথা হলো, প্রায়োগিক ও ব্যাবহারিক দিক থেকে বিচার করলে মৃন্ময়ী প্রতিমায় সরাসরি স্নানীয় দ্রব্য অর্পণ করার এটাই একমাত্র বাস্তব বিকল্প। আর দ্বিতীয় কথা হলো, এখানে দর্পণ আমাদের মন ও বুদ্ধির প্রতীক। আমাদের মন ও বুদ্ধি যত কালিমাশূন্য, যত জাগতিক বাসনাশূন্য হবে—সেই দর্পণে দেবীর উপস্থিতি তত স্পষ্টভাবে প্রত্যক্ষ করা যাবে। আমরা কালিমা, মলিনতা, ক্লেদ ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য স্নান করি। এখানে দেবীকে নানা দ্রব্যে স্নান করানো হচ্ছে একদিকে তাঁর প্রীতি উৎপাদনের জন্য, আর অন্যদিক দিয়ে দেখলে—নানাবিধ দ্রব্য দিয়ে দর্পণে এই স্নান আসলে সাধকের নিজেরই মন-বুদ্ধিকে (মনস্) নির্মল ও শুদ্ধতম করে তোলার এক প্রয়াস, যাতে এই মন তার মনরূপী সত্তাকে অতিক্রম করে, এই বুদ্ধি তার বুদ্ধিরূপী সত্তাকে অতিক্রম করে (কারণ, মন ও বুদ্ধি তো আখেরে জড় সত্তা বই আর কিছু নয়, আর জড় সত্তা দিয়ে চেতনকে অর্থাৎ দেবীকে পাওয়া যায় না) সর্ববিধ উপাধি-নির্মুক্ত হয়ে শুদ্ধ মন এবং শুদ্ধ বুদ্ধিতে পরিণত হতে পারে। শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধি এবং শুদ্ধ আত্মা (এখানে দেবী) এক—এটি শ্রুতির নির্ঘোষণা (‘যথোদকং শুদ্ধে শুদ্ধমাসিক্তং তাদৃগেব ভবতি’৬) এবং ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবেরও উক্তি।
মানুষের শরীর শুধুমাত্র ভোগভূমিই নয়; এই শরীরে কর্ম করে কর্মফলের উপার্জন এবং পুনঃপুন ভোগের মধ্য দিয়ে কর্ম ও কর্মফলের প্রতি নিরাসক্তি জন্মায়। মানুষ যখনি কর্মফল ভোগে নিরাসক্ত হয়ে ওঠে তখন তার মধ্যে ব্রহ্মজিজ্ঞাসার উদয় হয় এবং শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসনাদির মধ্য দিয়ে আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পথে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে সুসংস্কৃত বুদ্ধিদর্পণে (এই বুদ্ধি এখন বস্তুত আর বুদ্ধি-পদবাচ্য নয়) প্রত্যগাত্মাকে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত হতে দেখে; এই অবস্থাকেই শ্রুতি জীবন্মুক্তির অবস্থা বলে বর্ণনা করেছে। দেবী দুর্গার মহাস্নানে দর্পণের (আদর্শ) ব্যবহারে এই তত্ত্বেরই প্রতীকী ব্যঞ্জনা ধরা পড়ে। কঠোপনিষদ-এর মন্ত্রে বলা হয়েছে : “যথাদর্শে তথাত্মনি যথা স্বপ্নে তথা পিতৃলোকে/ যথাপ্সু পরীব দদৃশে তথা গন্ধর্বলোকে/ ছায়াতপয়োরিব ব্রহ্মলোকে।”৭ দর্পণে নিজ প্রতিবিম্ব দর্শনের মতো (এই মানবশরীরে) নির্মল বুদ্ধিরূপ দর্পণে স্পষ্ট আত্মবিষয়ক জ্ঞান হয়, পিতৃলোকে স্বপ্নে দেখার মতো অস্পষ্ট আত্মবিষয়ক জ্ঞান হয়, জলে দৃষ্ট বিকৃত প্রতিবিম্বের মতো গন্ধর্বলোকেও প্রত্যগাত্মার বিকৃত প্রতিচ্ছবির দর্শন হয়। তবে ব্রহ্মলোকেও আলো-ছায়ার ভেদের মতো (সাদা-কালো ছবির মতো পরিষ্কার) স্পষ্ট আত্মবিষয়ক জ্ঞান হয়। কিন্তু, ‘স চ দুষ্প্রাপঃ’৮—এই ব্রহ্মলোকপ্রাপ্তি অতীব অসম্ভবপ্রায় হওয়ার কারণে এই মানবশরীর বিনাশপ্রাপ্ত হওয়ার আগেই বুদ্ধিকে নির্বাসনা, বৈরাগ্য সহায়ে নির্মল করে আত্মজ্ঞান স্বরূপতা প্রাপ্ত হওয়ার চেষ্টা করা উচিত—এটিই শ্রুতিসিদ্ধান্তের তাৎপর্য। দেবীপূজায় মহাস্নানে দর্পণ ব্যবহারের এখানেই প্রাসঙ্গিকতা।
মহাস্নানপর্বের প্রথমেই দেবীকে যথাক্রমে যেন তাঁর নিদ্রাজনিত শারীরিক জড়তা এবং মানসিক জড়তা কাটানোর জন্য গরম জল, দাঁত মাজার বিল্বকাষ্ঠ-নির্মিত দাঁতনকাঠি এবং মাজন হিসাবে শ্বেতবর্ণ তণ্ডুলচূর্ণ (চালের গুঁড়ো) নিবেদন করতে করতে দুটি মন্ত্রোচ্চারণ করতে হয়। প্রথম মন্ত্রে শুনতে পাই, যেন দেবীকে উপলক্ষ করে নিজেরই শারীরিক জড়তা অর্থাৎ স্থূলশরীরের জড়তানাশের প্রার্থনা—‘ওঁ আয়ুর্বলং যশোবর্চঃ…’ ইত্যাদি। অর্থাৎ, হে বনস্পতি (দেবীই বনস্পতি)! তুমি আমাদের আয়ু, শক্তি, যশ, তেজ, প্রজা, গবাদি পশু, ধনধান্য, ব্রহ্মজ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মেধা দান কর। সোমরাজা যাতে সন্নিবেশিত হয়েছিলেন, তা আমার মুখে যশ এবং ভগ অর্থাৎ ষড়ৈশ্বর্যের দ্বারা প্রকৃষ্টরূপে বিকশিত হোক। দ্বিতীয় মন্ত্রে শুনতে পাই দেবীকে উপলক্ষ করে সাধকের নিজেরই মানসিক জড়তা অর্থাৎ সূক্ষ্মশরীরের জড়তানাশের প্রার্থনা—‘ওঁ চিত্রং দেবানাম্… জগতস্তস্থূষশ্চ’ ইত্যাদি। অর্থাৎ, কিরণপুঞ্জরূপ সূর্য (সূর্য বা আদিত্যই হিরণ্যগর্ভ বা অপরব্রহ্ম—যাকে প্রাণ, বায়ু, মাতরিশ্বা, একর্ষি, পূষণ, যম, প্রাজাপত্য প্রভৃতি নামে উপনিষদে ডাকা হয়েছে) আশ্চর্যজনকভাবে উদিত হচ্ছেন এবং সেই সূর্যই মিত্র-বরুণ ও অগ্নির মতো নিজের তেজে ভূলোক, দ্যুলোক ও অন্তরীক্ষলোকের প্রকৃত প্রকাশক এবং স্থাবর-জঙ্গমাত্মক জগতের আত্মা। অর্থাৎ, সূর্যকে পরব্রহ্মরূপে কল্পনা করলে তিনিই অপর ব্রহ্ম-সহ স্থাবর-জঙ্গমাত্মক ত্রিভুবনের প্রকৃত প্রকাশক এবং তিনিই ঈশ্বর-জীব-জগৎ-চতুর্বিংশতি তত্ত্ব, এমনকী মায়ারূপে প্রকাশিতও বটে; অর্থাৎ তিনিই এক এবং অদ্বিতীয় সত্তা—তিনি বই আর দ্বিতীয় সত্তার অস্তিত্ব নেই। নিশ্চিতভাবেই মানসিক জড়তা না কাটলে এহেন উচ্চতম তত্ত্বের সামান্যতম ধারণাও সম্ভব নয়।
উপনিষদে আছে—‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত।’৯ স্বামী বিবেকানন্দ এর অর্থ করেছেন—“ওঠো (শারীরিক জাগরণ), জাগো (শারীরিক জাগরণের পর মানস জাগরণ), লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত থেমো না।” অর্থাৎ, মানসিক জাগরণের পর goal orientation। মানসিক জাগরণের পরেই একমাত্র লক্ষ্যনির্ণয় ও সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা সম্ভব হয়। এখানে লক্ষ্যটি কী? না, “‘অহমস্মি’ ইতি নিবোধত, অবগচ্ছত”১০ অর্থাৎ, ‘আমিই সেই প্রত্যগাত্মা’—এই তত্ত্ব অনুভব করা। মহাস্নানের মন্ত্রে দেখি শারীরিক ও মানসিক জাগরণের পর দেবী নেত্রোন্মীলন করছেন “ওঁ তচ্চক্ষুর্দেবহিতং… ভূয়শ্চ শরদঃ শতাৎ” ইত্যাদি মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ, দেবগণের প্রিয় এবং শুদ্ধ সেই পরমেশ্বর জগতের চক্ষুরূপে পূর্বাকাশে উদিত হন। তাঁর প্রসাদে আমরা যেন শতবর্ষ দর্শন করি, শতবর্ষ ধরে জীবনধারণ করি, শতবর্ষ বাক্যালাপ করি, শতবর্ষ দৈন্যহীন হই এবং শতবর্ষ ছাড়িয়ে আরো দীর্ঘকাল (অনন্ত কাল) ঐরকম দর্শন, জীবনধারণ, বাক্যালাপ ইত্যাদি করতে পারি। সূর্যকে উপলক্ষ করে এই প্রার্থনা আসলে সেই পরব্রহ্মের উদ্দেশে প্রার্থনা—যাঁর অস্তিত্বের ফলে এই জড়সূর্যের (অপরব্রহ্মের) অস্তিত্ব; দীর্ঘ আয়ুলাভের প্রার্থনা কোনো জাগতিক বা শরীরী আয়ুলাভের বা আপেক্ষিক অমৃতত্বলাভের প্রার্থনা নয়, এ হলো শাশ্বত অমৃতত্ব লাভের প্রার্থনা—‘ভূয়শ্চ শরদঃ শতাৎ’।
এরপর দর্পণের প্রতিবিম্বে দেবীকে বিশেষরূপে চিন্তা করে তেল-হলুদ নিবেদন করতে করতে মন্ত্রোচ্চারণ করতে হয়—“ওঁ নানারূপধরে দেবি… চিত্রদোষো বিনশ্যতু” ইত্যাদি—হে নানারূপধারিণি, দিব্যবস্ত্রাবৃতা (অর্থাৎ, অবগুণ্ঠনবতী) দেবি! চন্দনাদির দ্বারা তোমার অনুলেপন মাত্রেই চিত্রদোষ বিনষ্ট হোক (চিত্র বা মূর্তি যাই হোক না কেন তা কখনোই সর্বাঙ্গসুন্দর হতে পারে না); হে দেবি! প্রচুর পরিমাণ চন্দন দিয়ে তোমাকে বিলেপিত করছি এবং এর ফলে তুমি প্রসন্ন হলে আমি অনেক শ্রী ও সম্পদ লাভ করব।
এরপর ঋগ্বেদ, শুক্লযজুর্বেদ, কৃষ্ণযজুর্বেদের বিভিন্ন বাছাই করা মন্ত্র এবং অন্য মন্ত্রাদি সহযোগে যেসকল বিবিধ দ্রব্য দিয়ে দেবীকে স্নান করানো হয়, সেগুলি হলো মোটামুটি এইরকম : (১) শোধিত পঞ্চগব্য (গোমূত্র, গোময়, দুগ্ধ, দধি, ঘৃত—কুশোদক), (২) শোধিত পঞ্চামৃত (দুগ্ধ, দধি, ঘৃত, শর্করা, মধু), (৩) স্বর্ণজল, (৪) রজতজল, (৫) নারিকেলোদক, (৬) শিশিরজল, (৭) গুড়জল, (৮) কর্পূরজল, (৯) তিলজল, (১০) বিষ্ণুতৈল, (১১) অগুরু, (১২) পুষ্করিণীজল, (১৩) বৃষ্টিজল, (১৪) পঞ্চকষায়জল (জাম, শিমূল, বেড়েলা বা বার্কলী, বকুল, কুল), (১৫) পঞ্চশস্যজল (যব, গম, মুগ, তিল, ধান), (১৬) কুঙ্কুমজল, (১৭) গোরোচনা, (১৮) সর্বৌষধি-মহৌষধি মিশ্রিত জল, (১৯) ইক্ষুরস, (২০) অষ্টকলসপূর্ণ জল (এক-একটি কলস যথাক্রমে গঙ্গাজল, বৃষ্টিজল, সরস্বতীনদীর জল, সাগরজল, পদ্মরেণু মিশ্রিত জল, ঝরনার জল, সর্বতীর্থের জল এবং চন্দনজলে পূর্ণ), (২১) সুগন্ধি জল এবং (২২) ১৯ রকমের মৃত্তিকা (যথা—বল্মীক মৃত্তিকা, বরাহদন্ত মৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা, বৃষশৃঙ্গ মৃত্তিকা, অশ্বদন্ত মৃত্তিকা, গজদন্ত মৃত্তিকা, পর্বত মৃত্তিকা, দেবদ্বার মৃত্তিকা, সরোবর মৃত্তিকা, নদীর উভয়কূল মৃত্তিকা, যজ্ঞশালা মৃত্তিকা, রাজদ্বার মৃত্তিকা, চতুষ্পথ মৃত্তিকা, গঙ্গা মৃত্তিকা, কুশমূল মৃত্তিকা, নদ মৃত্তিকা, নদী মৃত্তিকা, সাগর মৃত্তিকা ও গোষ্ঠ মৃত্তিকা), (২২) শঙ্খজল, (২৩) গঙ্গাজল, (২৪) উষ্ণজল, (২৫) গন্ধাঢ্যজল, (২৬) পুষ্পজল, (২৭) ফলোদক, (২৮) পঞ্চরত্নজল, (২৯) শুদ্ধজল প্রভৃতি। প্রসঙ্গত মনে রাখতে হবে যে, বিবিধ পূজাপদ্ধতি-ভেদে মহাস্নানে ব্যবহৃত দ্রব্যগুলির মধ্যে এবং সেগুলির ব্যবহারের ক্রমেও সামান্য সামান্য পার্থক্য দেখা যায়।
ডঃ হরিপদ আচার্য তাঁর মহালয়া থেকে বিজয়া গ্রন্থে মহাস্নানের বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছেন : “যেখানেই শ্রী, ঋদ্ধি, সিদ্ধি ও শক্তির প্রকাশ সেখানকার জল বা মাটি দেবীর খুব প্রিয়। তাইতো দেখি একদিকে যেমন প্রয়োজন উপরের বৃষ্টি জলের, তেমনি প্রয়োজন নীচের সাগর জলের। যেমন দরকার আকাশ ছেঁায়া পর্বতের মাটির, তেমনি চাই অকিঞ্চিৎকর বল্মীক (উঁই) ঢিপির মাটি। চলচঞ্চলা ঝর্ণার জল যেমন তাঁর প্রিয়, তেমনই প্রিয় আবদ্ধ জলা পুষ্করিণীর জল। দেবদ্বার ও রাজদ্বার মাটির মূল্য যতটুকু, বেশ্যাদ্বার এবং চতুষ্পথ মাটির দামও ততটুকুই। যাহা ক্ষুদ্র, যাহা তুচ্ছ; যাহা বিরাট অথবা মহান—সবই যে তাঁর, তিনি যে সবার। মায়ের মহিমা যেমন ক্ষুদ্রে তেমনি ভূমায় অর্থাৎ বিরাটে।”১১ কঠোপনিষদ-এ আছে—“অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্/ আত্মাঽস্য জন্তোর্নিহিতো গুহায়াম্।/ তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো/ ধাতুপ্রসাদান্মহিমানমাত্মনঃ॥”১২ প্রত্যগাত্মা সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর এবং বিশাল থেকে বিশালতর সকল প্রাণীর হৃদয়গুহায় স্থিত। শঙ্করাচার্য এই শ্লোকের ভাষ্যে লিখছেন : “অণু মহদ্বা যদস্তি লোকে বস্তু, তৎ তেনৈবাত্মনা নিত্যেনাত্মবৎ সম্ভবতি”—জগতে অণু অথবা মহৎ যাকিছু বস্তু আছে তা সমস্তই সেই নিত্য প্রত্যক্- চৈতন্যের সত্তাতেই সত্তাবান। “তদাত্মনা বিনির্মুক্তমসৎ সম্পদ্যতে”১৩—আর ঐ প্রত্যগাত্মার সঙ্গে সম্পর্কের কথা ভুল হয়ে গেলে সকল বস্তুই সত্তাহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু এই সর্বানুস্যূত ব্রহ্মশক্তির অস্তিত্ব অনুভবের সাধনায় সিদ্ধিলাভ না হওয়া পর্যন্ত ‘ভবতু নিশ্চয়দার্ঢ্যাদূর্ধ্বং শাস্ত্ররক্ষণম্’, ‘অন্যথা পাতিত্যাশঙ্কয়া’১৪—সাধারণত শাস্ত্রবাক্য বা, বলা ভাল, শাস্ত্রের সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তি এবং আচারনিষ্ঠ ব্যাখ্যা মেনে চলা উচিত; অন্যথায় মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুতির আশঙ্কা থাকে। তাই মহাস্নানে বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকার ব্যবহার প্রসঙ্গে মহানির্বাণতন্ত্র-এর টিপ্পনীতে তান্ত্রিক সাধকপ্রবরদের এই সাবধানবাণী বলতে শুনি—“দেবতা প্রতিষ্ঠার সময় বা দুর্গোৎসব প্রভৃতির সময় বেশ্যাদ্বারের মৃত্তিকা লইয়া তজ্জলে দেবতার অভিষেক করিলে দেবতার আবির্ভাব হয়, এরূপ বিধিও সর্বত্র দৃষ্ট হইতেছে। এই বেশ্যা যে কে, তা সাধারণে জ্ঞাত নহেন। অনেকে অজ্ঞান-নিবন্ধন বেশ্যাদ্বারের মৃত্তিকার স্থলে কুলটার দ্বারের মৃত্তিকা ব্যবহার করিয়া থাকেন। পরন্তু গুপ্তসাধনতন্ত্রে সদাশিব বেশ্যার লক্ষণ নির্দেশ করিয়া পরিশেষে বলিয়াছেন, ‘এবংবিধা ভবেদ্বেশ্যা ন বেশ্যা কুলটা প্রিয়ে।/ কুলটাসঙ্গমাদ্দেবি রৌরবং নরকং ব্রজেৎ॥’ ফলতঃ পূর্ণাভিষিক্তা শক্তিকেই বেশ্যা বলা হইয়া থাকে; ব্যাভিচারিণী কুলটা বেশ্যা-শব্দবাচ্য নহে। কালী, তারা, ত্রিপুরা প্রভৃতি দশ মহাবিদ্যা এবং তাঁহাদের আবরণ দেবতাকে বেশ্যা বলা যায়। পূর্ণাভিষিক্তা শক্তি কোন মহাবিদ্যার আবরণ দেবতার মধ্যে সন্নিবিষ্টা হয়েন বলিয়া তিনিও ‘বেশ্যা’ এই উচ্চ উপাধি প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। এই বেশ্যা সাত প্রকার; গুপ্তবেশ্যা, মহাবেশ্যা, কুলবেশ্যা, রাজবেশ্যা, দেববেশ্যা, ব্রহ্মবেশ্যা ও সর্ববেশ্যা। এই সপ্তবিধ বেশ্যার লক্ষণ গুপ্তসাধনতন্ত্রে এবং নিরুত্তরতন্ত্রে বিবৃত আছে।”১৫
‘ওঁ অগ্নিমীলে পুরোহিতং…’ ইত্যাদি বৈদিক মন্ত্র সহযোগে শীতল জলে দেবীকে স্নান করানোর পর ভৃঙ্গারপূর্ণ নদীজলে দেবীকে স্নান করানোর সময় ‘ওঁ শীতা চালকানন্দা চ চক্ষুর্ভদ্রা দৃষদ্বতী’ ইত্যাদি যে-মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়, সমাজতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, বৈদিক, পৌরাণিক, প্রাকৃতিক, দার্শনিক, আধ্যাত্মিক এবং সর্বোপরি অতীন্দ্রিয়তার প্রেক্ষাপটে বিচার করলে সেই মন্ত্রের জুড়ি খুঁজে বের করা দুরূহ হয়ে পড়ে। অনুপুঙ্খভাবে বিচার করলে মন্ত্রটিতে ভারতের সুপ্রাচীন নদ-নদী থেকে শুরু করে বিবিধ দৈবী সত্তার অস্তিত্বের ইঙ্গিত যেন মূর্ত হয়ে রয়েছে। অপরূপ এই মন্ত্রটির অর্থ হলো—শীতা, অলকানন্দা, চক্ষুর্ভদ্রা, দৃষদ্বতী, তুঙ্গভদ্রা, কৃষ্ণবর্ণা, পয়োষ্ণী, নর্মদা, তাপ্তী, ভীমরথী, শিপ্রা, বিতস্তা, ইরাবতী, গোদাবরী, বিপাশা, শতদ্রু, সিন্ধু, চর্মন্বতী, কাবেরী, তাম্রপর্ণী, মহানদী, করতোয়া, বাহুদা, শোণা, বেত্রবতী, দেবিকা, ভৈরবী, কোকা, গোমতী, উৎপলাবতী, আত্রেয়ী, ভারতী, গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, সরযূ, গণ্ডকী, পবিত্র শ্বেতগঙ্গা, কৌশিকী, পাতালস্থিত ভোগবতী, স্বর্গের মন্দাকিনী সকলে সুপ্রসন্না হয়ে ভৃঙ্গারের দ্বারা (অর্থাৎ এই ভৃঙ্গারের অন্তর্বর্তী হয়ে) তোমাকে স্নান করাক। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরাদি দেবতারা তোমার অভিষেক করুন। বাসুদেব জগন্নাথ, প্রভু সংকর্ষণ, অনিরুদ্ধ প্রমুখ দেবতারা তোমার বিজয়ের সহায় হোন—‘ভবন্তু বিজয়ায় তে’। ইন্দ্র, অগ্নি, যম, বরুণ, পবন, কুবের, শিব, ব্রহ্মা, অনন্ত, প্রভৃতি দিকপালগণ সদা তোমাকে রক্ষা করুক—‘দিক্পালাঃ পান্তু তে সদা’। কীর্তি, লক্ষ্মী, ধৃতি, মেধা, পুষ্টি, শ্রদ্ধা, ক্ষমা, মতি, বুদ্ধি, লজ্জা, বপু, কান্তি, শান্তি, তুষ্টি প্রভৃতি সংযমপরায়ণা ধর্মপত্নী মাতৃকামণ্ডলী (অন্তঃকরণের সদ্বৃত্তিসমূহ) তোমাকে অভিষিক্ত করুন—‘এতাস্ত্বামভিষিঞ্চন্তু ধর্মপত্ন্যঃ সমাগতাঃ’। সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু—এই নবগ্রহ পরিতৃপ্তি সহকারে তোমাকে অভিষিক্ত করুন। মুনিগণ, ঋষিগণ, গোসকল, দেবমাতা ও দেবপত্নীগণ, ধ্রুবগণ, নাগসকল, দৈত্যগণ ও অপ্সরাগণ, রাজাদের অস্ত্রশস্ত্রাদি ও বাহনসকল, ঔষধাদি, রত্নাদি, কাল (অর্থাৎ স্থান, কাল, পাত্র—এদের কেউই জড় নয়; সকলেই চেতন এবং এই সকলেরই মূল চেতয়িতা হলেন পরমাত্মা), কালের অবয়বসমূহ (ষড় ঋতু, পক্ষদ্বয়, উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়ন প্রভৃতি), নদীসকল, সমুদ্রাদি, পর্বতসমূহ, তীর্থসকল, মেঘসমূহ, নদসকল (অ-কারান্ত পুংলিঙ্গবাচক জলধারাসমূহ যেমন—ব্রহ্মপুত্র, শোণ, অজয় প্রভৃতি নদ; বাকি স্ত্রীবাচক অন্য জলধারাসমূহ নদী), দেবদানব, গন্ধর্বগণ এবং যক্ষ-রাক্ষস-পন্নগাদি সকলে ধর্ম কাম ও অর্থসিদ্ধির জন্য তোমার অভিষেক করুন। ভূতলস্থিত সিন্ধুভৈরব, শোণাদি হ্রদসকল প্রীতমনে ভৃঙ্গারের জলে তোমার স্নানকার্য সম্পাদন করুন। কুরুক্ষেত্র, প্রয়াগ, অক্ষয়বট, গোদাবরী, স্বর্গগঙ্গা, নর্মদা, মণিকর্ণিকাদি তীর্থসমূহ ভৃঙ্গারের জলে তোমার স্নানকার্য সম্পাদন করুন। পাতালতলবাসী তক্ষকাদি নাগগণ সকলে সুপ্রসন্নচিত্তে তোমাকে স্নান করান। দুর্গা, চণ্ডেশ্বরী, চণ্ডী, বারাহী, কার্তিকী, হরসিদ্ধা, কালী, ইন্দ্রাণী, বৈষ্ণবী, ভদ্রকালী, বিশালাক্ষী ও সর্বরূপিণী ভৈরবী প্রমুখ সকলে হৃষ্টমনে ভৃঙ্গারের দ্বারা তোমার স্নানকার্য সম্পাদন করুন।
মহাস্নানের সময় উচ্চারিত লৌকিক ছন্দোবদ্ধ মন্ত্রগুলির প্রায় সবকটিই অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত। কেবল দুটি মন্ত্র ইন্দ্রবজ্রা ছন্দে (‘স্যাদিন্দ্রবজ্রা যদি তৌ জগৌ গঃ’১৬—এই লক্ষণ অনুসারে ইন্দ্রবজ্রা ছন্দ ত-ত-জ-গ-গ গণ বিশিষ্ট) বিরচিত; ছন্দোবদ্ধ ধ্বনিমাধুর্যে তা অপরূপ ঝংকারের সৃষ্টি করে। শোধিত পঞ্চগব্য (মনে রাখতে হবে যে, আর্যসভ্যতায় গোধনের অবিসংবাদিত মর্যাদা, তাই পঞ্চগব্যেরও অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহিমা) একত্রিত করে দেবীকে স্নান করানোর সময় ইন্দ্রবজ্রা ছন্দে বিরচিত এই প্রথম মন্ত্রটি উচ্চারণ করা হয়—
“ওঁ যস্মাৎ পরং নাপরমস্তি মেধ্যং দেহেগতং যদ্বৃজিনং নিহন্তি।
নাস্তে পরং হৃদ্যমতস্তদেতৎ স্নানায় ভূয়াত্তব পঞ্চগব্যম্॥”
অর্থাৎ, যে-সত্তার থেকে শ্রেষ্ঠ অন্য কোনো কিছু নেই, দেহে প্রবেশ করে যা পাপ নাশ করে, যার থেকে পরম প্রীতিকরও অন্য কিছু হতে পারে না—সেই পঞ্চগব্য তোমার এই স্নানের নিমিত্ত হোক।
ইন্দ্রবজ্রা ছন্দোবদ্ধ দ্বিতীয় মন্ত্রটি (শোধিত পঞ্চামৃত একত্রিত করে স্নান করানোর সময় যা উচ্চারিত হয়) হলো—
“ওঁ সারং গৃহীত্বা জগতাং ত্রয়াণাং যন্নির্মিতং যজ্ঞকৃতে বিধাত্রা।
পঞ্চামৃতং তন্মধুরং মনোজ্ঞং সংস্নাপকং তে জগদম্ব ভূয়াৎ॥”
অর্থাৎ, বিধাতা যজ্ঞকার্য সম্পাদনের জন্য ত্রিজগতের সারবস্তু গ্রহণ করে যা তৈরি করেছিলেন, হে জগদম্বে! সেই মধুর, মনোহর পঞ্চামৃত তোমার স্নানীয় হোক। দুর্গাপূজায় মহাস্নানে পুরুষসূক্ত সহযোগে (বেলুড় মঠের দুর্গাপূজায় যা প্রচলিত) সহস্রধারা স্নান এবং চারটি বৈদিক মন্ত্র সহযোগে চারটি ঘটের জলে দেবীকে স্নান করানোর পর পুনরায় আটটি কলসের জলে স্নান করানোর সময় আটরকম রাগ পরিবেশিত হয়১৭ এবং বিবিধ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে আটরকম জলে দেবীকে স্নান করানোর বিধি পূজাপদ্ধতিতে পাওয়া যায়। সেগুলি হলো এইরকম—
(১) গঙ্গাজলপূর্ণ প্রথম কলস—মালবী বা মালব রাগে এবং ধাতব, কাংস্য বা পিতল-নির্মিত বাদ্যযন্ত্রাদির সাহায্যে উৎপন্ন ‘বিজয়বাদ্য’ সহযোগে।
(২) বৃষ্টিজলপূর্ণ দ্বিতীয় কলস—ললিত রাগে ‘দুন্দুভিবাদ্য’ সহযোগে।
(৩) সরস্বতীনদীর জলপূর্ণ কলস—বিভাস রাগে ‘দুন্দুভিবাদ্য’ সহযোগে।
(৪) সাগরের জলপূর্ণ কলস—ভৈরবীরাগে চামড়ার তৈরি ঢাক থেকে উৎপন্ন ‘ভীমবাদ্য’ সহযোগে।
(৫) পদ্মরেণু-মিশ্রিত জলপূর্ণ কলস—কেদার বা কোড়া রাগে বীণার সাহায্যে উৎপন্ন ‘ইন্দ্রাভিষেক বাদ্য’ সহযোগে।
(৬) নির্ঝর বা ঝরনার জলপূর্ণ কলস—বাড়ারী বা বৈরাটী রাগে ‘শঙ্খবাদ্য’ সহযোগে।
(৭) সর্বতীর্থের জলপূর্ণ কলস—বসন্তরাগে ধাতব, মনুষ্যকণ্ঠ, ঢাক, বীণা ও শঙ্খ থেকে উৎপন্ন ‘পঞ্চশব্দবাদ্য’ সহযোগে (যদিও ‘পঞ্চশব্দবাদ্য’ বলতে ধাতব, মনুষ্যকণ্ঠ, ঢাক, বীণা, বাঁশি বা সানাই থেকে উৎপন্ন শব্দকে বোঝায়; তবুও ‘দুর্গাগারে বংশিবাদ্যং মধুরীঞ্চ ন বাদয়েৎ’১৮—এই যোগিনীতন্ত্রের বচন অনুসারে দুর্গাপূজায় বাঁশি বা সানাই বাজানো যায় না বলে সেই জায়গায় শঙ্খ বাজাতে হয়।)
(৮) শুদ্ধজলপূর্ণ কলস—ধানশ্রী বা ধানসী রাগে ‘বিজয়বাদ্য’ সহযোগে।
এখন সাধারণভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, পূজাবিধিতে মহাস্নানকালে বিবিধ বাদ্য সহযোগে বিভিন্ন রাগ-রাগিণীতে মন্ত্রগুলি গাওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবক্ষেত্রে এত রকমের জটিল রাগ-রাগিণী গাওয়া বা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার সম্ভবপর না হওয়ায় কি পূজার অঙ্গচ্যুতি হয় না? এর উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য-সংহিতায় উল্লিখিত বিধির প্রসঙ্গ টেনে বলা যায় যে, যেকোনো এখন সাধারণভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, পূজাবিধিতে মহাস্নানকালে বিবিধ বাদ্য সহযোগে বিভিন্ন রাগ-রাগিণীতে মন্ত্রগুলি গাওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবক্ষেত্রে এত রকমের জটিল রাগ-রাগিণী গাওয়া বা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার সম্ভবপর না হওয়ায় কি পূজার অঙ্গচ্যুতি হয় না? এর উত্তরে যাজ্ঞবল্ক্য-সংহিতায় উল্লিখিত বিধির প্রসঙ্গ টেনে বলা যায় যে, যেকোনো মন্ত্রে উচ্চারণগত বা বিধিগত কোনো ন্যূনতা, অপূর্ণতা বা ছিদ্র যদি থেকেও থাকে, তাহলে সেই দোষ মন্ত্রের সঙ্গে ওঁকারের সংযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে বিনাশপ্রাপ্ত হয়। সুতরাং বিভিন্ন রাগ-রাগিণী ছাড়াই অষ্টকলস স্নানের প্রতিটি মন্ত্রই ওঁকার সংযুক্ত হয়ে পুণ্য ফল প্রদান করে—
“যন্ন্যূনঞ্চাতিরিক্তঞ্চ যচ্ছিদ্রং যদযজ্ঞিয়ম্।
যদমেধ্যমশুদ্ধঞ্চ যাতযামঞ্চ যদ্ভবেৎ।
তদোঙ্কারপ্রযুক্তেন সর্বঞ্চাবিফলং ভবেৎ॥”১৯
আর ঘণ্টা সর্ববাদ্যময়ী হওয়ার কারণে (‘ঘণ্টা ভবেদশক্তস্য সর্ববাদ্যময়ী যতঃ’—মৎস্যপুরাণ)২০ বাদ্যযন্ত্রগত যাবতীয় অপূর্ণতা দূর করে, তাই মহাস্নানের সময় ঘণ্টা বাজানোর কথা বলা হয়ে থাকে। শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বিরচিত শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থের মধ্যলীলায় শ্রীজগন্নাথের রথযাত্রার প্রাক্কালে চৈতন্য মহাপ্রভুর নেতৃত্বে গৌড়দেশ থেকে আগত ভক্তদের গুণ্ডিচামন্দির প্রক্ষালনের যে বিস্তৃত বিবরণ আছে, সেখানে আমরা পাই—
“প্রথমে করিল প্রভু মন্দির-প্রক্ষালন।
ঊর্দ্ধ্ব অধো ভিত্তি (মন্দিরের ওপর, নিচ দেওয়াল)
গৃহমধ্য সিংহাসন॥…
শত-ঘট জলে হৈল মন্দির-মার্জ্জন।
মন্দির শোধিয়া কৈল যেন নিজ মন॥
নির্ম্মল শীতল স্নিগ্ধ করিলা মন্দিরে।
আপন হৃদয় যেন ধরিল বাহিরে॥”২১
অর্থাৎ, পরিষ্কার করার পর মন্দিরের নির্মলতা, শীতলতা, স্নিগ্ধতা দেখে মনে হয়, মহাপ্রভু যেন নিজের হৃদয়কেই শ্রীজগন্নাথের বিশ্রামের জন্য শরীর থেকে বাইরে এনে শ্রীমন্দিররূপে রেখেছেন এবং গুণ্ডিচা মার্জনের অছিলায় নিজের অন্তরকেই ভগবানের বাসযোগ্য করে তুলেছেন। কবির গানে আমরা পাই—“আমার এ ঘর বহু যতন করে/ ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।/ আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে।”২২
তাই দুর্গাপূজায় দর্পণে মহাস্নান প্রসঙ্গে শেষমেষ মনে হয় যে, এসমস্ত রাজকীয় আয়োজনের গৌণ উদ্দেশ্য দেবীর প্রীতি উৎপাদন হলেও, মুখ্য উদ্দেশ্য হলো বোধহয় নিজ অন্তঃকরণের শুদ্ধির মধ্য দিয়ে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-এ উল্লিখিত শ্রীশ্রীঠাকুর-কথিত ‘শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধি, শুদ্ধ আত্মা’ (আত্মা অর্থে ব্রহ্ম এবং মনে রাখতে হবে—ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ) এক—এই পরম সত্যের উপলব্ধি। অথবা, মহাস্নান যেহেতু সাধকের পরম উপলব্ধির সহায়, তাই মহাস্নানের মুখ্য উদ্দেশ্য হলো দেবীর প্রীতি উৎপাদন—একথাও বলা চলে। একারণে মহাস্নান হলো সীমার মধ্য দিয়ে অসীমকে, রূপের মধ্য দিয়ে অরূপকে উপলব্ধিরই এক ভক্তজনোচিত আন্তরিক প্রয়াস।
তথ্যসূত্র
১. দ্র: ভট্টাচার্য, হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, স্মৃতি চিন্তামনিঃ, বিশ্ববাণী প্রকাশনী, কলকাতা, ১৪২৩, পৃ: ৯৮
২. তর্করত্ন, পঞ্চানন (সম্পাদিত), দেবীভাগবতম্, নবভারত পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৩৮৮, ১১।১৮।৬—১৫
৩. দ্রঃ শতপথব্রাহ্মণম্, জ্ঞান পাবলিশিং হাউস, দিল্লি, ১৯৩৯, ৪র্থ ভাগ, পৃ: ১৫৯
৪. ৪ দ্রঃ ক্রিয়াকাণ্ডবারিধি, বসুমতী করপোরেশন লিঃ, কলিকাতা, ২০২০, ১ম খণ্ড, পৃ: ২৮৩—৮৬
৫. বিদ্যালঙ্কার ভট্টাচার্য, রামতোষণ, প্রাণতোষিণী, বঙ্গীয় কলা বিদ্যালয়, কলকাতা, ২০১৩, পৃ: ২৭১
৬. কঠোপনিষদ, ২।১।১৫
৭. ঐ, ২।৩।৫
৮. ঐ, শাঙ্করভাষ্য
৯. কঠোপনিষদ, ১।৩।১৪
১০. ঐ, শাঙ্করভাষ্য
১১. আচার্য, ডঃ হরিপদ, মহালয়া থেকে বিজয়া, শান্তি আচার্য, নরেন্দ্রপুর, ১৩৯৮, পৃ: ৩
১২. কঠোপনিষদ, ১।২।২০
১৩. ঐ
১৪. নারদীয় ভক্তিসূত্র, ১২, ১৩
১৫. ভারতী, হরিহরানন্দ, মহানির্বাণতন্ত্র, রাজা ভৈরবেন্দ্র নারায়ণ ভূপ, ১৩৬৯, পৃ: ৭১৪
১৬. গঙ্গাদাস, ছন্দোমঞ্জরী, মেট্রোপলিটন প্রিন্টিং এণ্ড পাবলিশিং হাউস লিঃ, কলকাতা, ১৯৩৪, পৃঃ ৪৫
১৭. দ্রঃ স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ, মহিষাসুরমর্দিনী-দুর্গা, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ, কলিকাতা, ১৯৯০, পরিশিষ্ট, চতুর্থ
১৮. ভট্টাচার্য, রঘুনন্দন, অষ্টাবিংশতি তত্ত্বম্, সদেশ, কলকাতা, ১৪২৬, পৃঃ ৩১
১৯. ঐ, পৃঃ ২৯
২০. ঐ, পৃঃ ৩০
২১. গোস্বামী, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত, দেব সাহিত্য-কুটীর প্রাঃ লিঃ, কলিকাতা, ১৩৭৫, পৃঃ ২৬৬
ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, গীতবিতান, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, ১৪১২, পৃঃ ৬৮
স্বামী কৈলাসানন্দ স্মারক রূচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।
অধ্যক্ষ, ব্রহ্মচারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বেলুড় মঠ