ধ্যান, মনঃসংযম, একাগ্রতা প্রভৃতি শব্দ ও প্রসঙ্গগুলি স্বামীজীর বক্তৃতা, চিঠিপত্র ও রচনাবলিতে বারবার এসেছে৷ বিদেশে একটি বক্তৃতায় তিনি মনের মধ্যে নিহিত অশেষ শক্তির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, তিনি তিরিশ বছর কঠোর চেষ্টা করে মনঃশক্তির কিছুটা আয়ত্ত করেছেন এবং যা শিখেছেন ছবছর ধরে তা লোকের কাছে প্রচার করছেন৷ ১৮৯৯-র ২২ ডিসেম্বর ধীরামাতাকে একটি চিঠিতে লিখেছেন—ধ্যান, মনোযোগ ও একাগ্রতার সাধন করে সর্বপ্রকার উদ্বেগ ও দুর্ভাবনার অতীত হয়ে থাকার আলো তাঁর করায়ত্ত, আর করায়ত্ত গীতোক্ত ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য হয়ে কাজ করার কৌশল৷ যিনি আবাল্য ধ্যানসিদ্ধ, তাঁর কাছ থেকে ইত্যাকার উক্তি প্রত্যাশিত৷ বর্তমান প্রসঙ্গে আমরা স্বামীজীর চিন্তার আলোয় উপরি-উক্ত বিষয়গুলি নিয়ে কিছু আলোচনা করব৷


স্বামীজীর মতে, মনঃসংযম, একাগ্রতা ও ধ্যানের অভিযাত্রায় প্রথম প্রয়োজন হলো—পবিত্রতা ও নীতিপরায়ণতা৷ তিনি বলছেন : “মন যতই পবিত্র হবে, ততই তাকে সংযত করা সহজ হবে।… মনঃসংযমের অনুশীলন বিজ্ঞানসম্মত, ধীর, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদভাবে শিক্ষা করা উচিত৷ প্রথম প্রয়োজন সুনীতিপরায়ণ হওয়া৷… কারও কোনো অনিষ্ট না করা, পূর্ণ পবিত্রতা ও কঠোরতা।”


স্বামীজীর মতে, যে-মত আমাদের সনাতন ঋষিদেরও, সর্বশক্তি আমাদের ভিতরে৷ এই শক্তিকে জানার এবং নিজের চিরন্তন সম্পদরূপে চিনে নেওয়ার জন্য প্রধান যন্ত্র হলো মন৷


মন-বুদ্ধি-চিত্ত-অহংকার সমন্বিত আমাদের যে অন্তঃকরণ, স্বামীজী অনেক সময়ই তাকে সকলের সহজবোধ্য হওয়ার জন্য একযোগে ‘মন’ বলে বুঝিয়েছেন৷ বেদান্ত-মতে মনের লক্ষণ সংশয়—যাব কী যাব না, করব কী করব না—এইজাতীয় সংকল্প ও বিকল্প৷ বুদ্ধি ‘নিশ্চয়াত্মিকা’৷ সে নিশ্চয় বা সিদ্ধান্ত করতে পারে৷ মনের দোলাচলকে থামিয়ে সে এইজাতীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারে—হ্যাঁ, আমি যাব কিংবা না, যাব না৷ চিত্তের লক্ষণ স্মরণ৷ আর অহংকার হলো ‘আমি’ বোধ—মন-বুদ্ধি-চিত্তের প্রতিটি ক্রিয়ার মধ্যে সে অনুস্যূত থাকে৷ স্বামীজী বলছেন : “ভারতের ইতিহাসে এমন একটা যুগ ছিল, তখন শুধু মানুষ ও মানুষের মন—এই একটি বিষয়ে ভারতের সমগ্র মনোযাগ আকৃষ্ট হয়েছিল৷ তাতেই সে তন্ময় হয়ে গিয়েছিল৷” একটা সময়ে ভারতবর্ষে যথানিয়মে যেমন জড়বিজ্ঞান শেখানো হতো, তেমনি মনের শক্তি আয়ত্ত ও বিবিধভাবে তাকে প্রয়োগ করার বিদ্যাটিও প্রণালীবদ্ধ বিজ্ঞানের মতো শেখানো হতো৷ স্বামীজী বলছেন : “তাঁরা এই বিদ্যার নাম দিয়েছিলেন ‘রাজযোগ’৷ ভারতে হাজার হাজার লোক এই বিদ্যার চর্চা করে; এটি সে-জাতির নিত্য উপাসনার একটি অঙ্গ হয়ে গেছে৷”


মনের ছড়িয়ে পড়া অসীম শক্তিকে একজায়গায় সংহত করে আনাই হচ্ছে একাগ্রতা৷ স্বামীজীর মতে, এই একাগ্রতার শক্তিতেই পশুতে আর মানুষে তফাত৷ পশু তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বা ‘instinct’-এর প্রেরণায় কখনো হয়তো খাদ্যবস্তু বা শিকারের দিকে মন একাগ্র করতে পারে৷ কিন্তু তাছাড়া সে কখনো অন্য কোনো জিনিসের প্রতি বেশিক্ষণ মন দিতে পারে না৷ “মানুষে মানুষে পার্থক্যের কারণও আবার এই একাগ্রতার তারতম্য৷ সর্বনিম্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে সর্বোচ্চ স্তরের মানুষের তুলনা করে দেখ, দেখবে একাগ্রতার মাত্রা বিভিন্ন বলেই এই পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে৷”


স্বামীজী এই একাগ্রতা প্রসঙ্গে একটি সমস্যার কথাও উল্লেখ করেছেন৷ আসলে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই মনকে একাগ্র করার শক্তি রয়েছে এবং আমরা অধিকাংশ সময়ই যে-জিনিসটি ভালবাসি তার প্রতি আপনা-আপনিই আকৃষ্ট ও একাগ্র হয়ে পড়ি৷ কিন্তু এই ধরনের একাগ্রতা পরাধীন একাগ্রতা, যার সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে—“মন আমাদের আয়ত্তে থাকে না, বরং মনই আমাদের চালিত করে৷ যেন সম্পূর্ণ বাইরের কোনো বস্তু আমাদের মনটিকে টেনে নিয়ে যতক্ষণ খুশি নিজের কাছে রাখে৷… মনকে আমরা সেখান থেকে তুলে আনতে পারি না৷”৭ মনকে নিজের সম্পূর্ণ আয়ত্তে রেখে ইচ্ছামতো তাকে আমি আমার পছন্দমতো বিষয়ে কিংবা প্রয়োজনীয় বিষয়ে একাগ্র করব এবং আমার ইচ্ছামতো সেই বিষয় থেকে মনকে তুলে নিতেও পারব—এটিই হচ্ছে সঠিক একাগ্রতা৷ তাই স্বামীজী বলেছেন : “একাগ্রতার শক্তি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কোনো বিষয় বা বস্তু থেকে মন তুলে নেওয়ার শক্তিও বাড়িয়ে তুলতে হবে৷… এই উভয় ক্ষমতা সমভাবে অর্জন করে চললে বিপদের কোনো সম্ভাবনা থাকে না৷” একাগ্রতার মহতী শক্তি ও প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে স্বামীজী আরো বলেছেন : “আমার মতে, মনের একাগ্রতা-সাধনই শিক্ষার প্রাণ, শুধু তথ্যসংগ্রহ করা নয়৷ আবার যদি আমাকে নতুন করে শিক্ষালাভ করতে হতো এবং নিজের ইচ্ছামতো আমি যদি তা করতে পারতাম, তাহলে আমি শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাতাম না৷ আমি আমার মনের একাগ্রতা ও নির্লিপ্ততার ক্ষমতাকেই ক্রমে ক্রমে বাড়িয়ে তুলতাম; তারপর ঐভাবে গঠিত নিখুঁত যন্ত্রটির সাহায্যে (অর্থাৎ মনটির সাহায্যে) সুবিধামতো তথ্যসংগ্রহ করতে পারতাম৷”


স্বামীজীর মতে, জাগতিক বা পারমার্থিক যেকোনো জ্ঞানলাভের মূলেই রয়েছে একাগ্রতা৷ “রসায়নবিদ নিজের পরীক্ষাগারে মনের সম্পূর্ণ শক্তি কেন্দ্রীভূত করেন এবং যেসব বস্তু তিনি বিশ্লেষণ করছেন, তার ওপর তা প্রয়োগ করেন৷ এইভাবে তিনি ঐসব বস্তুর রহস্য অবগত হন৷ জ্যোতির্বিদ নিজের মনের সব শক্তি একত্রিত করে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমে আকাশে প্রয়োগ করেন, আর অমনি সূর্য-চন্দ্র-নক্ষত্র—সকলেই নিজের নিজের রহস্য তাঁর কাছে প্রকাশ করে৷”১০


আমরা সাধারণত বাহ্যবিষয়েই মনোনিবেশ করতে অভ্যস্ত থাকি; আমাদের সমাজ ও সমাজে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সেই শিক্ষাই দেয়৷ কিন্তু বাহ্যজগতের মতো আমাদের অন্তর্জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভেরও প্রধান উপকরণ মন৷ মনকে অন্তর্জগতের ওপর প্রয়োগ করেই বিভিন্ন মত ও পথের ধর্মসাধকরা অন্তর্জগতের সত্যকে আবিষ্কার করেন এবং আধ্যাত্মিক সিদ্ধি বলতে তাঁরা যা বোঝেন, সেই সিদ্ধি লাভ করেন৷


স্বামীজী বলছেন, মনকে অন্তর্জগতে স্থির করা বহির্বিষয়ে স্থির করার চেয়ে অনেক কঠিন৷ কারণ, এখানে জ্ঞানের বিষয় একটা আভ্যন্তরীণ বস্তু, অর্থাৎ মন, যেটিকে বাহ্য ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখা যায় না৷ জ্যোতির্বিদ যেমন তাঁর মনকে আকাশের নক্ষত্রের দিকে প্রয়োগ করেন, এখানে আমার মনকে আমার নিজের মনের ওপরেই প্রয়োগ করতে হবে৷ তবে কঠিন হলেও এটি করা সম্ভব, কারণ “মনের এমন একটি ক্ষমতা আছে, যার দ্বারা সে নিজের ভিতরটা দেখতে পারে। একে মনের অন্তঃপর্যবেক্ষণশক্তি বলা হয়৷”১১ মন সাধারণত নিজেকে দুভাগ করে অবস্থান করে; স্বামীজীর ভাষায়—‘the player and the witness’৷১২ মনের এক ভাগ নানা বিষয়ের ওপরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আরেক ভাগ সা‌ক্ষিস্বরূপ অনুভব করছে যে, মনটি ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ আমরা যে অনেক সময় বলি, আমার মনটা আজ অস্থির আছে কিংবা শান্ত আছে—সেটা আমরা বলতে পারি, আমার ঐ সা‌ক্ষী মনটির আমার মনের বাকি অংশ সম্বন্ধে যে-অভিজ্ঞতা, সেটির ওপর ভিত্তি করে৷ স্বামীজী উদাহরণ দিচ্ছেন : “আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলছি, আবার একইসঙ্গে আমি যেন আরেকটি লোক—কী করছি তা জানছি ও শুনছি৷”১৩ অর্থাৎ আমি যে কথা বলছি, অন্য কাজ করছি না—সেটা জানছি এবং কী কথা বলছি তা শুনছি৷


স্বামীজী বলছেন, মনের এই সা‌ক্ষী অংশটিকে শক্তিশালী করে তার দ্বারাই আমাদের মনের চঞ্চল বাকি অংশটিকে স্থির করতে হবে৷ স্বামীজীর ভাষায় : “Now strengthen the witnessing part and do not waste time in restraining your wanderings.”১৪ মনকে আয়ত্ত করার এই কাজটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, স্বামীজী বলছেন—একটুও সময় নষ্ট না করে তোমার লেগে পড়া উচিত ‘তোমার এই পরিভ্রমণকে’ অর্থাৎ তোমার মনের এই পরিভ্রমণকে দমন করার কাজে৷ মনের এই চঞ্চল ভাবটি বোঝানোর জন্য স্বামীজী একটি বাস্তব উদাহরণ দিচ্ছেন, বলছেন : “হয়তো এই মুহূর্তে আমি ভাবলাম যে, আমার মন ঠিক আছে এবং আমি ঈশ্বরের ওপরে ধ্যান করব, কিন্তু এক মিনিটের মধ্যেই দেখলাম, আমার মনটা লন্ডনে চলে গেছে!”১৫ এর কারণ, মনকে সচেতনভাবে একাগ্র করার অভ্যাস আমরা অধিকাংশ মানুষই করি না৷ তাই আমাদের মন আমাদের অপে‌ক্ষা না রেখে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং যখনি আমাদের মনকে আমরা নিজেদের ইচ্ছামতো চালানোর চেষ্টা করি, মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে৷ কিন্তু নিয়মিত অনুশীলন করলে এই মনকে আয়ত্তে আনা যায় এবং আয়ত্তাধীন মনকে একাগ্র করে মনের ওপর প্রয়োগ করা যায়৷ স্বামীজী উদাহরণ দিচ্ছেন—যেমন সূর্যের আলো যেখানে পড়ে, সেখানকার আনাচে-কানাচে পর্যন্ত সবকিছু সকলের চোখে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, তেমনি সাক্ষী মনের সচেতন চেষ্টায় যখন সমগ্র মন একাগ্র হয়ে ওঠে, তখন সেই একাগ্র মনের আলোকে ও শক্তিতে আমরা নিজেদের মনকে বিশ্লেষণ করতে পারি এবং মনের গভীরে যে চিরন্তন সত্য আছে, সেসম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করি৷ এই পর্যন্ত বলে স্বামীজী নিজেই প্রশ্ন করছেন এবং উত্তরও দিচ্ছেন : “এরকম জ্ঞানের উপকারিতা কী? প্রথমত, জ্ঞানই জ্ঞানের সর্বোচ্চ পুরস্কার৷ দ্বিতীয়ত, এই জ্ঞানের উপকারিতাও আছে; এই জ্ঞান সমস্ত দুঃখ দূর করবে৷ যখন মানুষ নিজের মন বিশ্লেষণ করতে করতে এমন এক বস্তুর সাক্ষাৎ পায়, যার কোনোকালে নাশ নেই—যা স্বরূপত নিত্যপূর্ণ ও নিত্যশুদ্ধ, তখন আর তার দুঃখ হয় না৷”১৬ অর্থাৎ আত্মসাক্ষাৎকার করে আত্যন্তিক দুঃখনিবৃত্তি হয় তার৷ ভয় ও অপূর্ণ বাসনাই সব দুঃখের মূল৷ ঐ অবস্থা লাভ করলে মানুষ বুঝতে পারে, তার মৃত্যু নেই; সুতরাং তখন আর তার মৃত্যুভয় থাকে না৷ নিজেকে পূর্ণ বলে অনুভব করে বলে কোনো বাসনাও থাকে না৷ এই হলো মনঃসংযম, একাগ্রতা ও ধ্যানের পরম লক্ষ্য ও প্রাপ্তি—জ্ঞানপথে চলা সাধকের ক্ষেত্রে সচ্চিদানন্দস্বরূপ আত্মসাক্ষাৎকার আর ভক্তিপথের সাধকের ক্ষেত্রে সচ্চিদানন্দময় বা সচ্চিদানন্দময়ী ইষ্টের দর্শন৷

এই মনঃসংযম, একাগ্রতা ও ধ্যানকে সব মতের সাধকরাই গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন রূপে গ্রহণ করলেও রাজযোগের সাধকরা এগুলির সাধনকে নির্দিষ্ট প্রণালীবদ্ধ করে তাকে একেবারে বিজ্ঞানের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন৷ পতঞ্জলির যোগসূত্রের প্রথম অধ্যায়টির দ্বিতীয় সূত্রটি হলো—“যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধ।” চিত্তের বৃত্তিগুলির নিরোধই হলো যোগ অর্থাৎ চিত্তকে বিভিন্ন প্রকার বৃত্তিতে পরিণত হতে দেওয়া চলবে না৷ সেটিই যোগ৷ স্বামীজী তাঁর রাজযোগ গ্রন্থে এই সূত্রটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চিত্তকে একটি হ্রদের সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং বৃত্তিগুলিকে বলেছেন সেই হ্রদের ঢেউ। তিনি বলছেন : “আমরা হ্রদের তলদেশ দেখতে পাই না, কারণ হ্রদের উপরিভাগটি ছোট ছোট তরঙ্গে আবৃত৷ যখন তরঙ্গগুলো শান্ত হয়, জল স্থির হয় তখনি কেবল হ্রদের তলদেশ ক্ষণিকের জন্য দেখতে পাওয়া যায়৷ যদি জল ঘোলা থাকে বা ক্রমাগত নড়তে থাকে, তাহলে হ্রদের তলদেশ কখনোই দেখা যাবে না৷ যদি জল নির্মল থাকে এবং তাতে একটিও তরঙ্গ না থাকে, তবেই আমরা তার তলদেশ দেখতে পাব৷ হ্রদের তলদেশটি আমাদের প্রকৃত স্বরূপ—হ্রদটি চিত্ত আর তার ঢেউগুলি বৃত্তি৷” “এই চিত্ত সর্বদাই তার স্বাভাবিক পবিত্র অবস্থা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু ইন্দ্রিয়গুলি তাকে বাইরে আকর্ষণ করছে৷ চিত্তকে দমন করা, তার এই বাইরে যাওয়ার প্রকৃতিকে নিবারণ করা এবং তাকে প্রত্যাবৃত্ত করে সেই চৈতন্যঘন পুরুষের দিকে ফিরে যাওয়ার পথ দেখানো—এটাই যোগের প্রথম সোপান৷”১৭


চিত্ত নিজেকে এই কয়েকটি রূপে প্রকাশ করে থাকে—ক্ষিপ্ত, মূঢ়, বিক্ষিপ্ত, একাগ্র এবং নিরুদ্ধ৷ অর্থাৎ চিত্তের মধ্যে যে-ধরনের বৃত্তি বা ঢেউ ওঠে, সেই অনুযায়ী চিত্ত এই পাঁচ অবস্থায় থাকে৷ ‘ক্ষিপ্ত’ অবস্থার লক্ষণ কর্মশীলতা৷ এই অবস্থায় চিত্তের প্রবণতা হয় সুখ ও দুঃখের রূপে নিজেকে প্রকাশ করা৷ ‘মূঢ়’ অবস্থার লক্ষণ তমোগুণ৷ এই অবস্থায় চিত্তের মধ্যে কেবল অন্যের অনিষ্ট করার বৃত্তি জাগে৷ আর ‘বিক্ষিপ্ত’ অবস্থা আগের দুটি অবস্থা থেকে ভাল। এই অবস্থায় চিত্ত নিজেকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য সংগ্রাম করে৷ টীকাকারের মত বলে উল্লেখ করে স্বামীজী বলেছেন : “বিক্ষিপ্ত অবস্থা দেবতাদের জন্য স্বাভাবিক এবং ক্ষিপ্ত ও মূঢ় অবস্থা অসুরদের জন্য স্বাভাবিক৷ ‘একাগ্র’ অবস্থায় চিত্ত কেন্দ্রীভূত হওয়ার চেষ্টা করে৷ তখন চিত্তের বৃত্তিগুলি ক্রমশ কমতে শুরু করেছে৷ ‘নিরুদ্ধ’ অবস্থায় আর কোনো বৃত্তি নেই৷ সব বৃত্তি থেমে গেছে৷ চিত্তহ্রদে আর কোনো তরঙ্গ নেই৷ এই অবস্থাই আমাদের সমাধিতে পৌঁছে দেয়৷” স্বামীজী বলছেন : “যখনি তরঙ্গগুলি শান্ত হয়ে যায় এবং হ্রদ শান্তভাব ধারণ করে, তখনি আমরা হ্রদের তলদেশ দেখতে পাই৷ মনও ঠিক তাই—যখনি মন শান্ত হয়ে যায়, তখনি আমরা বুঝতে পারি, আমাদের প্রকৃত স্বরূপ কী৷ তখন আমরা আর চিত্তের তরঙ্গগুলির সঙ্গে নিজেদের মিশিয়ে ফেলি না—নিজেদের স্বরূপেই অবস্থিত থাকি৷”১৮


পতঞ্জলির যোগসূত্রে (১।১২) বলা হয়েছে—অভ্যাস এবং বৈরাগ্যের দ্বারা চিত্তের বৃত্তিগুলিকে নিরোধ করা যায়৷ স্বামীজী ঐ সূত্রটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অভ্যাসের বিশেষ প্রশস্তি করেছেন৷ বলেছেন : “আমাদের অভ্যাস করতে হয় কেন? কারণ, আমাদের প্রতিটি কাজই চিত্তহ্রদের উপরিভাগে একটি কম্পন সৃষ্টি করে৷ এই কম্পন একসময় মিলিয়ে যায়৷ কিন্তু থাকে কী? সংস্কারগুলি থেকে যায়, আমাদের কাজ বা চিন্তার ছাপগুলি থেকে যায়৷ যখন এরকম অনেকগুলি ছাপ মনের মধ্যে পড়ে, তখন সেগুলি একসাথে মিলে একটি অভ্যাস তৈরি হয়৷ বলা হয় যে, ‘অভ্যাসই দ্বিতীয় স্বভাব’৷ অভ্যাস শুধু ‘দ্বিতীয় স্বভাব’ই নয়, প্রথম স্বভাবও বটে—মানুষের সম্পূর্ণ স্বভাবই এই অভ্যাসের ওপর নির্ভর করে৷ আমরা এখন যেরকম প্রকৃতিবিশিষ্ট, তার পুরোটাই আমাদের পূর্ব-অভ্যাসের ফল৷ এর থেকে আমরা এই সান্ত্বনা পাই যে, যদি মানুষের স্বভাব কেবলমাত্র অভ্যাসের ওপর ভিত্তি করে, তবে সেই অভ্যাসকে আমরা যেকোনো সময় প্রয়োজনমতো তৈরি করতে বা দূর করতে পারি৷” কোনো মানুষ অসৎ মানে সে অসৎ কাজ ও চিন্তার অভ্যাস সৎ কাজ ও চিন্তার থেকে বেশি করেছে৷ তাই তার ভিতরে সৎ ভাবকে ছাপিয়ে অসৎ ভাব প্রবল হয়ে উঠেছে৷ কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তার কোনো আশা নেই৷ আজ থেকে সে যদি সৎ অভ্যাস করতে পারে, তবেই তার অসৎ সংস্কার দূর হয়ে গিয়ে সে সচ্চরিত্র হয়ে উঠবে৷ স্বামীজী বলছেন : “কখনো বলো না যে, অমুকের কোনো আশা নেই; কারণ সে কেবল একটি বিশেষ চরিত্রের, একগুচ্ছ মন্দ অভ্যাসের পরিচয় দিচ্ছে—যে-অভ্যাসগুলিকে নতুন ভাল অভ্যাসের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব৷ চরিত্র হলো বারবার অভ্যাসের সমষ্টি এবং কেবলমাত্র বারবার সৎ অভ্যাসের দ্বারাই চরিত্র সংশোধন করা সম্ভব৷ মন্দ অভ্যাসের একমাত্র প্রতিকার—তার বিপরীত অভ্যাস৷ যত মন্দ অভ্যাস আমাদের চিত্তে মন্দ ছাপ ফেলে রেখেছে, ভাল অভ্যাসের দ্বারাই সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷ কেবল ভাল কাজ করে যাও, অবিরাম পবিত্র চিন্তা করতে থাক; অসৎ সংস্কারকে দমন করার এটিই একমাত্র উপায়৷”১৯

যোগসূত্রের ১।১৫ নং সূত্রে বলা হয়েছে—দৃষ্ট ও শ্রুত সবরকম বিষয়ভোগের বাসনাত্যাগই হলো বৈরাগ্য৷ স্বামীজী এই সূত্রের ব্যাখ্যায় বলছেন : “দুটি শক্তি আমাদের সব কাজের নিয়ামক—(১) আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা, (২) অপরের অভিজ্ঞতা৷ এই দুটি শক্তি আমাদের মনোহ্রদে নানা তরঙ্গ উৎপন্ন করে৷ বৈরাগ্য হলো এই শক্তি-দুটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ও মনকে বশে রাখার শক্তিস্বরূপ৷” নিজে অতীতে যা উপভোগ করেছি, সেই ভোগের আকর্ষণ আমার চিত্তহ্রদে বাসনার ঢেউ জাগায়৷ আবার নিজে ভোগ করিনি, অন্যের কাছ থেকে সেই ভোগের কথা শুনে মনে মনে লোভ জেগেছে৷ সেটিও আমার চিত্তহ্রদে বাসনার ঢেউ তোলে৷ আমি এই দুই প্রকার ঢেউয়ের কোনোটিকেই আমার মধ্যে উঠতে দেব না৷ আমি বিচার করে মনকে এমন শান্ত ও শক্ত করে তুলব যাতে ঐ দুই প্রকার বিষয়ভোগের হাতছানি আমার সামনে এলেও আমার চিত্তহ্রদে ঐ বিষয়ভোগজনিত কোনো বৃত্তির ঢেউ কখনোই উঠবে না৷ স্বামীজী বলছেন : “নিজের অভিজ্ঞতা এবং অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের মধ্যে যে দুই প্রকার কার্যপ্রবৃত্তি জন্মায়, সেগুলিকে দমন করা এবং এইভাবে চিত্তকে তাদের বশীভূত হতে না দেওয়া—একেই বলে বৈরাগ্য৷ প্রবৃত্তিগুলি যেন আমার আয়ত্তে থাকে, আমি যেন তাদের আয়ত্তাধীন না হই—এই প্রকার মানসিক শক্তিকে বৈরাগ্য বলে৷ বৈরাগ্যই মুক্তির একমাত্র উপায়৷”২০ অর্থাৎ অভ্যাস ও বৈরাগ্য—নিরন্তর ধৈর্যসহ মনঃসংযমের চেষ্টা এবং ঈশ্বর বা পরমার্থ ব্যতীত সর্ববিষয়ে স্পৃহাশূন্যতা—এই দুটিরই যুগপৎ প্রয়োজন পরমার্থ বিষয়ে মন নিবিষ্ট করার জন্য৷ ইন্দ্রিয়সুখ ও বিষয়সুখের দিকে ধাবমান মনকে লক্ষ্যপথে ফিরিয়ে আনার জন্য বৈরাগ্যের প্রয়োজন এবং নিরন্তর ধৈর্যসহ প্রচেষ্টার দ্বারা এই ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াটিও ক্রমশ অভ্যাসে পরিণত হয়৷


স্বামীজী তাঁর বিখ্যাত রাজযোগ গ্রন্থটিতে পতঞ্জলির যোগসূত্রের প্রতিটি সূত্র ধরে ধরে অনুবাদ করেছেন এবং তার সঙ্গে নিজের ব্যাখ্যাও যোগ করেছেন৷ এটি স্বামীজীর বক্তৃতা নয়—‘লিখিত’ গ্রন্থ৷ তিনি গ্রন্থাকারে প্রকাশের জন্যই নিউ ইয়র্কের একটি সাধারণ ভাড়া করা বাড়িতে বাছাই করা শিষ্য-শিষ্যার সামনে পাতঞ্জল যোগসূত্রের ব্যাখ্যা করে গেছেন এবং তাঁর শিষ্যা মিস ওয়াল্ডো শ্রুতিলেখকের কাজ করে এই অমূল্য গ্রন্থটিকে জগদ্বাসীর জন্য লভ্য করেছেন৷ এসম্পর্কে মিস ওয়াল্ডোর স্মৃতি-সা‌ক্ষ্যটি চমকপ্রদ৷ তখন ফাউন্টেন পেন জগতে আসেনি৷ স্বামীজী বলে যেতেন আর কালি-ভরা দোয়াতে কলমের নিবটি প্রয়োজন-মতো ডুবিয়ে নিয়ে নিয়ে ওয়াল্ডো লিখে যেতেন৷ মাঝে মাঝেই স্বামীজী ব্যাখ্যা করতে করতে গভীর ধ্যানস্থ বা সমাধিস্থ হয়ে পড়তেন৷ আবার সাধারণ ভূমিতে নেমে এসে ব্যাখ্যা করতে শুরু করতেন৷ এই সময়টা ওয়াল্ডো কালির দোয়াতে নিবটি ডুবিয়ে রেখে গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতেন, যাতে অতীন্দ্রিয় ভূমি থেকে নেমে এসে স্বামীজী যা বলবেন, তার একটি শব্দও বাদ না পড়ে৷ ১৮৯৫ সালের জুন মাসের মধ্যে স্বামীজী রাজযোগ লেখা শেষ করেছিলেন৷


পতঞ্জলির যোগসূত্রের অনুসরণে স্বামীজী তাঁর রাজযোগ গ্রন্থে ‘সাধনার প্রথম সোপান’ হিসাবে যোগের এই অষ্টাঙ্গের উল্লেখ করেছেন—যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান ও সমাধি৷ এর মধ্যে শেষ তিনটি হলো ‘অন্তরঙ্গ সাধন’—ধারণা, ধ্যান ও সমাধি৷ ‘যম’ থেকে শুরু করে ‘প্রত্যাহার’ পর্যন্ত প্রথম পাঁচটি সাধন ঐ তিনটির তুলনায় বহিরঙ্গ৷


‘যম’ মানে হলো অহিংসা, সত্য, অস্তেয় (অচৌর্য), ব্রহ্মচর্য, অপরিগ্রহ৷ ‘নিয়ম’ হলো শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায় (অধ্যাত্মশাস্ত্র পাঠ) ও ঈশ্বরপ্রণিধান৷ স্বামীজী ঈশ্বর-প্রণিধানের অর্থ করেছেন—ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ৷ এই যম আর নিয়ম হলো চরিত্রগঠনের সাধনা৷ স্বামীজী বলেছেন : “এই দুটিকে ভিত্তি হিসেবে না রাখলে কোনোরূপ যোগসাধনাই সিদ্ধ হবে না৷” এর অর্থ হলো—কোনোরকম ধর্মসাধনাই চরিত্রগঠন না হলে সার্থক হতে পারে না; কারণ আমাদের প্রত্যেকের ধর্মসাধনাই জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ ও রাজযোগের একক বা মিশ্রিত রূপ৷ কাজেই সাধনার আবশ্যিক ভিত্তি হিসাবে স্বামীজী যে চরিত্রগঠনের ওপর জোর দিয়েছেন তা সব সাধকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য৷ সাধনার তৃতীয় সোপান হলো আসন; অর্থাৎ ধ্যান বা একাগ্রতা সাধনের সময় কীভাবে বসব৷ এসম্পর্কে স্বামীজীর নির্দেশ—“যতদিন না কিছুটা উচ্চ অবস্থা লাভ হয়, ততদিন প্রত্যহ নিয়মিতভাবে কতকগুলো শারীরিক ও মানসিক প্রক্রিয়া পরপর অভ্যাস করতে হয়৷ কাজেই দীর্ঘকাল একভাবে বসে থাকতে পারা যায়, এমন একটা আসন খুঁজে বের করা বিশেষ জরুরি৷ যাঁর পক্ষে যে-আসনটি সবচেয়ে সহজ মনে হয়, তিনি সেই আসনটি বেছে নেবেন৷”২১


যম-নিয়মের দ্বারা চরিত্রকে পবিত্র থেকে পবিত্রতর, নিখুঁত থেকে নিখুঁততর করার সাধনা সাধকের চলতেই থাকবে—এই সাধনা সারাদিন সারা সপ্তাহ সারাক্ষণ ধরে চলা বাঞ্ছনীয়৷ কিন্তু এছাড়াও যোগী বা সাধক যে দৈনন্দিন সাধনা করবেন, তা শুরু হবে যোগী আসন করে বসা থেকে৷ স্বামীজী বলছেন—আসন করে বসার পরেই সাধকের কর্তব্য জগতের সকলের উদ্দেশে শুভেচ্ছাভরা চিন্তাস্রোত বইয়ে দেওয়া৷ “মনে মনে বল—‘জগতে সকলেই সুখী হোক, সকলেই শান্তি লাভ করুক, সকলেই আনন্দ লাভ করুক৷’ এইভাবে পূর্বে, পশ্চিমে, উত্তরে, দক্ষিণে পবিত্র চিন্তা প্রবাহিত কর৷ যত এরকম করবে, ততই তুমি নিজে ভাল বোধ করবে৷ পরিশেষে দেখতে পাবে যে, অপরে সুস্থ থাকুক—এই ভাবনাই স্বাস্থ্যলাভের সহজ উপায়৷ অপর সকলে সুখী হোক—এরকম চিন্তাই নিজেকে সুখী করার সহজ উপায়৷ তারপর, যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস কর, তাদের ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা কর্তব্য। অর্থ নয়, স্বাস্থ্য নয়, খ্যাতি নয়, প্রার্থনা করবে জ্ঞানালোকের জন্য৷ এছাড়া সব প্রার্থনাই স্বার্থমিশ্রিত৷ তারপর তোমাকে চিন্তা করতে হবে তোমার নিজের দেহ সম্বন্ধে,… কারণ এটিই হলো শ্রেষ্ঠ যন্ত্র—যা তুমি পেয়েছ (ভগবৎপথে অগ্রসর হওয়ার জন্য)৷ চিন্তা করবে যে, তোমার শরীর পর্বতের মতো দৃঢ় এবং এই শরীরের সাহায্যেই তুমি জীবনসমুদ্র উত্তীর্ণ হবে৷ দুর্বল ব্যক্তি কখনো মুক্তিলাভ করতে পারে না৷ সর্বপ্রকার দুর্বলতা পরিত্যাগ কর৷ শরীরকে বল—তুমি বলিষ্ঠ; মনকে বল—তুমি বলিষ্ঠ; আর নিজের ওপর অসীম বিশ্বাস ও ভরসা রাখ৷”২২ এইভাবে শরীর ও মনকে অসীম উৎসাহে উজ্জীবিত করে প্রতিদিনের সাধনা শুরু করতে হবে৷


সাধনার পরবর্তী সোপান প্রাণায়াম৷ ‘প্রাণ’ ও প্রাণায়াম সম্বন্ধে স্বামীজী রাজযোগ গ্রন্থে যা বলেছেন তার সারমর্ম এই—“অনেকে মনে করেন, প্রাণায়াম শ্বাস-প্রশ্বাসের কোনো ব্যাপার৷ বাস্তবিক তা নয়৷ শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে প্রাণায়ামের সম্পর্ক অতি অল্পই৷ প্রকৃত প্রাণায়াম সাধন করতে গেলে অনেকগুলো ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া তার মধ্যে একটি৷” ভারতীয় দর্শন-মতে সমগ্র জগৎ দুটি উপাদানে তৈরি—একটি হলো ‘আকাশ’, আরেকটি হলো ‘প্রাণ’৷ আকাশ মানে অবশ্যই আমাদের সকলের মাথার ওপরের নীল আকাশ নয়৷ “এই আকাশ একটি সর্বব্যাপী সত্তা, যা সব বস্তুর মধ্যে অনুস্যূত আছে৷ যেকোনো বস্তু যার কোনো রূপ বা আকার আছে, যেকোনো বস্তু যা অন্যান্য বস্তুর মিশ্রণে উৎপন্ন হয়েছে অর্থাৎ সৃষ্টির যেকোনো মৌলিক বা যৌগিক বস্তু—এই আকাশ থেকেই উৎপন্ন হয়েছে৷ এই আকাশই বায়ু, তরল ও জগতের সমস্ত কঠিন পদার্থের রূপ ধারণ করে৷ সূর্য, পৃথিবী, নক্ষত্র, সর্বপ্রাণীর শরীর, উদ্ভিদ, পশু, মানুষরূপ ও আকারযুক্ত সব বস্তুই আকাশ থেকে উৎপন্ন৷” ২৩ সৃষ্টির আদিতে একমাত্র আকাশই ছিল৷ আবার সৃষ্টির অবসানে অর্থাৎ কল্পান্তে সমস্ত কঠিন, তরল ও বায়বীয় পদার্থ আকাশেই লয় হয়৷ পরবর্তী সৃষ্টি আকাশ থেকেই শুরু হয়৷২৪


কিন্তু কোন্ শক্তির প্রভাবে আকাশ এইভাবে জগৎ-রূপে পরিণত হয়? প্রাণের শক্তিতে৷ যেমন আকাশ এই জগতের অনন্ত সর্বব্যাপী উপাদান, প্রাণও সেরকম এই জগতের অনন্ত সর্বব্যাপী প্রকাশিকা শক্তি৷ কল্পের আদিতে ও অন্তে সব বস্তুই যেমন আকাশে পরিণত হয়, জগতের সব শক্তিই তেমন প্রাণে লয় হয়৷ পরবর্তী কল্পে আবার এই প্রাণ থেকেই সব শক্তির বিকাশ হয়৷ এই প্রাণের প্রকৃত তত্ত্ব জানা এবং তাকে নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টাই প্রাণায়ামের প্রকৃত অর্থ৷ এই প্রাণায়ামে সিদ্ধ হলে আমাদের কাছে অনন্ত শক্তির দ্বার খুলে যায়৷


কীভাবে এই প্রাণকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেটিই প্রাণায়ামের একমাত্র উদ্দেশ্য৷ প্রাণায়ামের যতকিছু সাধন ও উপদেশ আছে—সকলেরই সেই এক উদ্দেশ্য৷ এখন প্রত্যেক সাধকেরই উচিত সে যেখানে আছে, সেখান থেকেই তার সাধনা শুরু করা এবং তার সবচেয়ে কাছে যেগুলি আছে, সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার শিক্ষাই তার প্রথমে লাভ করা উচিত৷ জগতের সব জিনিসের মধ্যে আমার দেহই আমার সবচেয়ে কাছাকাছি আছে, আর আমার মন আমার আরো কাছে আছে৷ আর যে-প্রাণ সৃষ্টির সর্বত্র ক্রিয়া করছে, তার যে-অংশটি আমার এই শরীর ও মনকে চালাচ্ছে—সেই প্রাণটুকু আমার সবচেয়ে নিকটের৷ যে শুদ্ধ প্রাণতরঙ্গ আমাদের শারীরিক ও মানসিক শক্তিরূপে প্রকাশিত, তা আমাদের কাছে সৃষ্টিব্যাপী অনন্ত প্রাণসমুদ্রের সবচেয়ে নিকটবর্তী তরঙ্গ৷ প্রাণায়ামের সাধক প্রাণসমুদ্রের সেই নিকটতম ঢেউটিকে ধরে সমগ্র প্রাণসমুদ্রকে আয়ত্তে আনতে চেষ্টা করেন৷ প্রাণায়াম-সাধনার সেটিই রহস্য ও উদ্দেশ্য৷


একাগ্রতা ও ধ্যানের সাধনায় কেন প্রাণায়াম অবলম্বন করা ভাল, স্বামীজী তার আরেকটি কারণ অত্যন্ত সরলভাবে বলেছেন : “মনকে সংযম করতে হলে প্রথমে শরীরের দিক থেকে আরম্ভ করা সহজ৷” “যে-যন্ত্র যত বেশি সূক্ষ্ম, তার শক্তিও তত বেশি। মন শরীরের চেয়ে অনেক বেশি সূক্ষ্ম এবং অধিকতর শক্তিসম্পন্ন৷” তাই “মন অপেক্ষা শরীরের সঙ্গে সংগ্রাম করা অনেক সহজ কাজ৷”


প্রাণায়ামের উপযোগিতার কথা বলেও স্বামীজী প্রাণায়াম সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন নিম্নলিখিত উক্তিটিতে : “মনের নিয়ন্ত্রণ আরম্ভ করতে হয় প্রাণায়াম থেকে৷ নিয়মিত শ্বাসক্রিয়ার ফলে দেহে সমতা আসে; তখন মনকে ধরা সহজ হয়।… (কিন্তু) স্বকপোলকল্পিত কৌশল অবলম্বন করে মন-নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করো না৷ একমাত্র সহজ সরল শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াই এপথে যথেষ্ট৷ বিবিধ কঠোর সাধন-সহায়ে মনকে একাগ্র করতে প্রয়াসী হলে ভুল করা হবে৷ সেসব করতে যেও না৷”২৫ স্বামীজী তাঁর রাজযোগ গ্রন্থে ‘অধ্যাত্মপ্রাণের সংযম’ অধ্যায়ে তিনটি সরল প্রাণায়ামের বর্ণনা করেছেন, যার মধ্যে প্রথম ও তৃতীয়টি সম্বন্ধে তিনি বলেছেন যে, ঐ দুটি করা কঠিন নয় এবং তাতে কোনো বিপদেরও আশঙ্কা নেই৷২৬


প্রাণায়ামের পরের সাধন-সোপান হলো—প্রত্যাহার৷ স্বামীজী বলছেন : “প্রত্যাহার হচ্ছে মনকে গুটিয়ে এনে ঈপ্সিত বস্তুতে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা৷ এর প্রথম ধাপ—মনকে ছেড়ে দিয়ে তার ওপর নজর রাখা এবং দেখা—মন কী ভাবে? যখনি কোনো চিন্তার ওপর বিশেষ নজর দেবে, অমনি সে-চিন্তা বন্ধ হয়ে যাবে; কিন্তু চিন্তাগুলিকে জোর করে বন্ধ করার চেষ্টা করো না, কেবল সা‌ক্ষী হয়ে দেখে যাও৷”২৭


এ যেন দুরন্ত অদম্য ঘোড়াকে ছুটিয়ে ছুটিয়ে প্রথমে ক্লান্ত করে দেওয়া এবং তারপর হীনবল ঘোড়াকে সহজেই আস্তাবলে নিয়ে যাওয়া৷ স্বামীজী বলছেন : “লোকে বলে জ্ঞানই শক্তি—একথা অতি সত্য৷ যতক্ষণ না জানতে পারবে—মন কী করছে, ততক্ষণ তাকে সংযত করতে পারবে না৷ মনকে যথেচ্ছ বিচরণ করতে দাও৷… প্রথম কয়েক মাস দেখবে তোমার মনে অসংখ্য চিন্তা আসছে, ক্রমশ দেখবে চিন্তা কিছুটা কমেছে, আরো কয়েক মাস পরে আরো কমে গেছে। অবশেষে মন সম্পূর্ণভাবে বশীভূত হবে, কিন্তু প্রতিদিনই আমাদের ধৈর্যের সঙ্গে অভ্যাস করতে হবে৷”২৮


স্বামীজী প্রত্যাহারের আরেকটি বিপরীত পদ্ধতির কথাও বলেছেন। “আরেকটি পদ্ধতি হলো—‘নেতি নেতি’—এটা নয়, এটা নয়; মনের যে-ঢেউগুলো মনকে বহির্মুখী করতে চায়, সেগুলিকে থামিয়ে দেওয়া৷ এর ফলে শেষকালে মনের যেন মৃত্যু হয় এবং যা সত্য তা নিজেকে প্রকাশ করে৷”২৯


প্রত্যাহারের পরে আসে ধারণা, ধ্যান ও সমাধি৷ এগুলি ধ্যানেরই তিনটি পর্যায়৷ প্রত্যাহারের দ্বারা মনকে বিভিন্ন বস্তু থেকে গুটিয়ে এনে যদি একটি বস্তুতে লাগিয়ে রাখতে পারি, তবে সেটিকে বলে ‘ধারণা’৷ যদি বেশ কিছুক্ষণ সেই বস্তুতেই মন লেগে থাকে, তবে সেটি হলো ‘ধ্যান’৷ ‘সমাধি’ হলো ধ্যানের গভীর অবস্থা৷ যে-বস্তুর ওপর মনকে নিবিষ্ট করেছি, সেই বস্তুর সমস্ত বাহ্য রূপ বা উপাধি বর্জন করে আমার মন যদি সেই বস্তুটির ভাব বা অর্থটিতে নিবিষ্ট হয়ে থাকে, তবে ধ্যানের সেই অবস্থাকে বলব সমাধি৷


ধারণা-ধ্যান-সমাধির পর্যায়ক্রমটি স্বামীজী চিত্তহ্রদের ঢেউয়ের উপমাটি দ্বারা আরো সহজ করে বুঝিয়েছেন৷ ধারণার সময় মন যে-বস্তুতে নিবিষ্ট হয়েছে, সেই বস্তুটিকে অবলম্বন করে সেই চিত্তহ্রদে একটি বিশেষ ঢেউ উঠতে থাকে৷ চিত্তহ্রদে তখন অন্য ঢেউও থাকে৷ কিন্তু ধ্যেয়বস্তু-ভিত্তিক ঢেউটিই প্রধান থাকে; অন্য ঢেউগুলি এই ঢেউটিকে গ্রাস করতে পারে না৷ ধীরে ধীরে অন্য ঢেউগুলি অর্থাৎ অন্য বৃত্তিগুলি বিলীন হয়ে যায়, শুধু ধ্যেয়বস্তু সম্পর্কিত ঢেউটিই থাকে৷ চিত্তহ্রদে সেই ঢেউটিই তখন বারবার ওঠে৷ যখন কোনো অবলম্বনের প্রয়োজন হয় না, সম্পূর্ণ মনটিই যখন একটি তরঙ্গরূপে পরিণত হয়—মনের সেই একরূপতার নাম ‘সমাধি’৷ তখন আর কোনো বিশেষ স্থান ও কেন্দ্রের সাহায্যের প্রয়োজন হয় না৷ ধ্যেয়বস্তুটিও থাকে না—ধ্যেয়বস্তুর ভাবটি কেবল অবশিষ্ট থাকে৷


আধ্যাত্মিক সাধনায় স্বামীজী সর্বদাই ধ্যানকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন৷ ধ্যান সম্পর্কে তাঁর কয়েকটি উক্তি—“আধ্যাত্মিক জীবনে ধ্যানই মানুষকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে৷” “জগতের সব ধর্মেই ধ্যানের ওপরে জোর দেওয়া হয়েছে৷ মনের ধ্যানাবস্থাকেই যোগীরা উচ্চতম অবস্থা বলে ঘোষণা করেছেন৷… অন্য সব কিছুর চেয়ে ধ্যানই আমাদের সত্যের সর্বাপেক্ষা কাছে নিয়ে আসে৷” “ধ্যানের শক্তিতে আমরা সব কিছু পেতে পারি৷… আজকের যত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তা ধ্যানের শক্তিতেই হয়েছে৷… ধ্যানের শক্তি ছাড়া কোনোরকম জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়৷”৩০


“ধ্যানের মানেই হলো মনকে তার নিজের কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ সেই সময় মন তার সব চিন্তাতরঙ্গকে থামিয়ে দিয়েছে৷ সঙ্গে সঙ্গে জগৎও যেন থেমে গেছে৷ কিন্তু তোমার চেতনা ধ্যানকালে প্রসারিত হয়৷


“প্রতিবার যখন তুমি ধ্যান করবে, তোমার উন্নতি হবে৷… তুমি যখন ধ্যান থেকে বেরিয়ে আসবে, তখন তোমার মনে হবে—তুমি তোমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বিশ্রামটি উপভোগ করেছ৷ তোমার শরীরযন্ত্রকে ঠিক ঠিক বিশ্রাম দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো ধ্যান৷ এরকম বিশ্রাম তুমি গভীরতম ঘুমেও পাবে না৷ গভীরতম ঘুমের সময়ও মন লাফাতে থাকে৷ ধ্যানের ঐ কয়েকটি মিনিটেই তোমার মস্তিষ্ক প্রায় থেমে যায়৷ তাই ধ্যানের সময়েই আমাদের সর্বাপেক্ষা নিখুঁত বিশ্রাম হয়৷”৩১ স্বামীজী তাঁর শিষ্য-শিষ্যাদের বলেছেন : “যতই ব্যস্ত থাক না কেন, প্রতিদিন অন্যথা না করে ধ্যান-অভ্যাস করো৷”৩২

“এমনকী অল্পসময়ের জন্য হলেও, ধর কয়েক মিনিটের জন্য হলেও তোমাকে ধ্যান করতে হবে৷ যদি অন্য কোনোভাবেই ধ্যানের সময় না পাও, তুমি বাথরুমে গিয়েও ধ্যান করতে পার৷”৩৩


প্রসঙ্গের বিপরীত একটি কথাও স্বামীজী একবার বলেছিলেন তাঁর এক পাশ্চাত্য শিষ্যাকে৷ ঘটনার স্থান : ক্যাম্প পারসি৷ ধ্যানের ক্লাসে স্বামীজী তাঁকে অনুপস্থিত দেখে নিজেই খুঁজতে গিয়েছিলেন৷ ক্যাম্পের রান্নাঘরে গিয়ে দেখেন, সেই ‘অনুপস্থিত’ শিষ্যা পরম যত্নে তাঁদেরই জন্য কিছু রান্না করছেন৷ তিনি তাঁর কাছে গিয়ে বললেন : “Well, never mind; our Master said you could leave meditation for service.”—শ্রীরামকৃষ্ণ বলে গেছেন, সেবার জন্য তুমি ধ্যানকে ত্যাগ করতে পার৷৩৪


মনের শক্তি এবং তার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহার সম্পর্কে স্বামীজী ক্যালিফোর্নিয়ায় ৮ জানুয়ারি ১৯০০ তারিখে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বিষয় ছিল : ‘The Powers of the mind’। বক্তৃতাটিতে স্বামীজী তাঁর একটি নতুন মতের কথা বলেছেন, যার প্রতিপাদ্য হলো—মানবসভ্যতা প্রকৃত পূর্ণতা লাভ করবে তখনি যখন মনঃসংযম, একাগ্রতা ও ধ্যানের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ যে-‘বিজ্ঞান’ একসময় আবিষ্কার করেছিল, তার ওপর নির্ভর করে মানুষ চলবে৷
তিনি তাঁর একটি নিজস্ব তত্ত্বের কথা বক্তৃতাটিতে বলেছেন : “কোনো জাতি যেসব অবস্থার ভিতর দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, সেই জাতির প্রত্যেক মানুষকেই শৈশবে দ্রুতগতিতে ঐসব অবস্থা অতিক্রম করে আসতে হয়৷ যেসব অবস্থা পার হয়ে আসতে একটা জাতির হাজার বছরের প্রয়োজন হয়েছে, সেসব পার হতে শিশুটির প্রয়োজন হয় মাত্র কয়েক বছর—এইটুকু যা প্রভেদ৷ শিশুটি প্রথমে আদিম অসভ্য মানুষেরই মতো থাকে—সে পায়ের তলায় প্রজাপতি দলে চলে৷ প্রথম অবস্থায় শিশুটি স্বজাতির পূর্বপুরুষেরই মতো৷ যত বড় হতে থাকে, বিভিন্ন অবস্থার ভিতর দিয়ে চলতে চলতে শেষে সে জাতির পরিণত অবস্থায় এসে পৌঁছায়।”৩৫—অর্থাৎ একটি শিশু যে শৈশব থেকে পরিণত বয়সে পৌঁছায়—তার ঐ জীবনের মধ্যে ধরা থাকে সেই জাতির শৈশব অবস্থা থেকে বর্তমান পরিণত অবস্থাপ্রাপ্তি পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিবর্তনটির প্রতিচ্ছবি৷


প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের জীবনের পূর্ণতাপ্রাপ্তি যেমন আত্মস্বরূপ উপলব্ধিতে বা ঈশ্বরলাভে (সেই পূর্ণতাপ্রাপ্তির জন্য প্রতিটি মানুষ যত্নবান হোক বা নাই হোক), তেমনি সমষ্টিগতভাবে সমগ্র মানবজাতির পূর্ণতাপ্রাপ্তিরও একটি লক্ষ্য আছে৷ সেই পূর্ণতাপ্রাপ্তির অবস্থাটি সম্বন্ধে কোনো ধারণা সাধারণ মানুষের জীবন থেকে আমরা পাই না, কিন্তু মাঝে মাঝে যে মহাশক্তিধর অবতার বা অবতারসদৃশ কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসেন—তাঁদের জীবন থেকে সমগ্র মানবজাতির পূর্ণতাপ্রাপ্তির অবস্থাটি সম্বন্ধে আমরা ধারণা পেতে পারি৷ শ্রীরামকৃষ্ণের নাম না করে স্বামীজী তাঁর দিকেই ইঙ্গিত করে বলেছেন : “সম্প্রতি এই সেদিনকার কথা—এমন একজন মানব এসেছিলেন, যিনি এই জন্মেই সমগ্র মানবজাতির জীবনের সমগ্র পথ অতিক্রম করে চরম সীমায় পৌঁছেছিলেন৷”৩৬ অর্থাৎ মানবজাতির অগ্রগতির পূর্ণ অবস্থাটি কী সেটা আমরা শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন থেকে পেয়ে গেছি৷ যেমন একটি গাছের বীজ লাগালে গাছটি তার স্বাভাবিক পরিণতির দিক এগুবে, তেমনি মানবসভ্যতাও সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাত, পতন-অভ্যুদয়, বন্ধুর পন্থার মধ্য দিয়ে সেই পূর্ণাবস্থায় পৌঁছাবেই৷ স্বামীজী বলছেন, এটি যেমন সত্য, তেমনি “এও আমাদের অজানা নয় যে, কিছু অতিরিক্ত সাহায্য পেলে এই উন্নতি আরো ত্বরান্বিত হয়৷ আমরা গাছপালা বৃদ্ধির সহায়তা করি; করি না কি? প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিলেও গাছগুলি বেড়ে উঠত, তবে দেরি হতো; বিনা সাহায্যে যতদিনে বাড়ত, তার চেয়ে অল্পসময়ে বাড়ার জন্য গাছগুলিকে আমরা সাহায্য করি৷ একাজ আমরা সর্বদাই করছি৷ আমরা কৃত্রিম উপায়ে বস্তুর বৃদ্ধির গতি দ্রুততর করে তুলছি। মানুষের উন্নতিই বা দ্রুততর করতে পারব না কেন? জাতি হিসাবে আমরা তা করতে পারি৷”৩৭


যে-পদ্ধতি অবলম্বন করে ভারত এই কাজটি করবে, সেই পদ্ধতিটির উপায় ও অনুশীলনে ভারত দক্ষ৷ সেটি হলো—মন ও তার অসীম শক্তির অনুশীলন৷ “ভারতের ইতিহাসে এমন একটি যুগ ছিল, তখন শুধু মানুষ ও মানুষের মন—এই একটি বিষয়ে ভারতের সমগ্র মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছিল৷ তাতেই সে তন্ময় হয়ে গিয়েছিল৷… যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করলে মনের অসাধ্য কিছুই নেই—এই বিষয়ে ভারতীয় মনে এতখানি দৃঢ় বিশ্বাস এসেছিল যে, মনঃশক্তির গবেষণাই তার মহান লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল৷”৩৮ এই গবেষণারই ফলশ্রুতি আমাদের বিভিন্ন শাস্ত্রে বিধৃত মনঃসংযম, একাগ্রতা ও ধ্যান-ধারণাদি বিষয়ে প্রণালীবদ্ধ সুস্পষ্ট পথনির্দেশ৷ মন ও তার শক্তির অনুশীলনের এই বিজ্ঞান সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান বা বিদ্যা৷ কারণ, এর দ্বারা মানুষ পূর্ণতালাভ করতে পারে৷ স্বামীজী বলেছেন : “এর তুলনায় অর্থ ও অন্যান্য জাগতিক বস্তু দান করে অপরকে সাহায্য করা বা দৈনন্দিন জীবনে কিভাবে নির্ঝঞ্ঝাটে চলা যায়, তা শিক্ষা দেওয়া—এসব নিতান্তই তুচ্ছ আনুসঙ্গিক কাজ৷”৩৯ স্বামীজী বলছেন—মন ও তার শক্তি অনুশীলনের এই বিজ্ঞান শেখার জন্য বিষয়কর্মের থেকে অনেক বেশি খাটতে হয়৷ নিজের সম্বন্ধে তিনি বলছেন যে, তিনি তিরিশ বছর খেটেছেন মন সংক্রান্ত এই বিজ্ঞানটিকে আয়ত্ত করতে৷ “কখনো কখনো চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কুড়ি ঘণ্টা খেটেছি৷ কখনো রাত্রে মাত্র একঘণ্টা ঘুমিয়েছি৷ কখনো-বা সারারাত্রিই পরিশ্রম করেছি৷ কখনো কখনো এমন সব জায়গায় বাস করেছি যাকে প্রায় শব্দহীন, বায়ুহীন বলা চলে৷… আর এসব সত্ত্বেও আমি অতি অল্পই জানি বা কিছুই জানি না৷ আমি যেন এই বিজ্ঞানের বহির্বাসের প্রান্তটুকু মাত্র স্পর্শ করেছি৷ কিন্তু আমি ধারণা করতে সক্ষম হয়েছি যে, এই বিজ্ঞানটি সত্য৷ সুবিশাল ও অত্যাশ্চর্য৷… বক্তৃতায় এই বিজ্ঞান শেখানো যায় না, কারণ এ হলো জীবনগঠনের কথা৷ আর জীবনই অপরের ভিতর জীবন সঞ্চার করতে পারে৷”৪০

ভবিষ্যতে মানবজাতি যে পূর্ণতার লক্ষ্যে যাবে, তা মনের এই অসীম শক্তির চর্চা করে—মনঃসংযোগ, একাগ্রতা, ধ্যান-ধারণা, সমাধিলাভের তপস্যাকে জীবনের অঙ্গ করে৷ যাঁরা এই তপস্যায় সিদ্ধ, তাঁরাই কেবল এই তপস্যার শিক্ষা দিতে পারেন৷ বিশ্বসভ্যতার পূর্ণতার যাত্রায় তাই অন্তর্মুখ, ধ্যানপরায়ণ, আধ্যাত্মিক ভারতকেই নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে হবে৷

তথ্যসূত্র

১. দ্র: স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৯৯৯, ৩য় খণ্ড, পৃ: ৩১০
২. দ্র: ঐ, ২০০০, ৮ম খণ্ড, পৃঃ ৬০-৬১
৩. The Complete Works of Swami Vivekananda, Advaita Ashrama, Calcutta, 1985, vol. IV, pp. 220-21
৪. Ibid., 1983, vol. II, p. 20
৫. Ibid., p. 12
৬. স্বামী বিবেকানন্দ, মন ও তার শক্তি, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৯, পৃঃ ২৭ (এই পুস্তকের উদ্ধৃতিগুলির সাধুভাষা চলিতে রূপান্তরিত)
৭. ঐ, পৃ: ২৮
৮. ঐ, পৃ: ২৯
৯. ঐ
১০. C.W., 1986, vol. I, p. 130
১১. Ibid., p. 131
১২. Ibid., 1985, vol. VI, p. 135
১৩. Ibid., vol. I, p. 131
১৪. C.W., vol. VI, p. 135
১৫. Ibid., p. 248
১৬. C.W., vol. I, p. 130
১৭. Ibid., pp. 202-203
১৮. Ibid., p. 203
১৯. Ibid., pp. 207-08.
২০. Ibid., pp. 208-09
২১. Ibid., p. 137
২২. Ibid., pp. 145-46
২৩. Ibid., p. 147
২৪. দ্রঃ বাণী ও রচনা, ১৯৯৮, ১ম ভাগ, পৃঃ ১৮৪-৮৬
২৫. মন ও তার শক্তি, পৃঃ ৩০-৩১
২৬. C.W., vol. I, p. 166। প্রথম প্রাণায়ামটি হলো : দু নাক দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে শ্বাস গ্রহণ এবং ভিতরে ধরে না রেখে দু নাক দিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণে প্রশ্বাস ত্যাগ। এই শ্বাস গ্রহণ ও শ্বাসত্যাগের সময় “ওঙ্কার বা অন্য কোনো পবিত্র শব্দ মনে মনে উচ্চারণ করলে ভাল হয়।” তৃতীয় প্রাণায়ামটি হলো : দু নাক দিয়ে ৪ সেকেণ্ড শ্বাসগ্রহণ, দু নাক দিয়ে ৮ সেকেণ্ড প্রশ্বাস ত্যাগ, তারপর বাইরে ১৬ সেকেণ্ড শ্বাসবায়ুকে ধরে রাখা। সতর্কতা হিসাবে স্বামীজী বলেছেন : প্রাণায়ামগুলি একবার শুরু করলে নিয়মিত করে যাওয়া উচিত। অতিরিক্ত করা উচিত নয়। যথেষ্ট নিরাপদ সংখ্যা হলো : একটি প্রাণায়াম সকালে চারবার এবং সন্ধ্যা কালে চারবার করে যাওয়া।
২৭. বাণী ও রচনা, ১ম ভাগ, পৃঃ ১৫৪-৫৫
২৮. C.W., vol. I, pp. 174-75
২৯. Ibid., vol. V, p. 300
৩০. Ibid., vol. IV, pp. 227—30
৩১. Ibid., p. 235
৩২. His Eastern & Western Admirers, Reminiscences of Swami Vivekananada, Advaita Ashrama, 2012, p. 354
৩৩. Ibid., p. 354
৩৪. Ibid., p. 369
৩৫. C.W., vol. II, p. 18
৩৬. Ibid., p. 19
৩৭. Ibid., p. 18
৩৮. Ibid., p. 20
৩৯. Ibid., p. 19
৪০. Ibid., pp. 22-23

‘স্বামী নির্বাণানন্দ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।

সহকারী সাধারণ সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন