ইতিহাস অনুসারে বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্রের সূচনা হয়েছে উনিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে। তবে তার আগে হিকি সাহেবের হাত ধরে বাংলা থেকে ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’ (২৯ জানুয়ারি ১৭৮০) ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। আর শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম মাসিক সাময়িকপত্র ‘দিগদর্শন’; ২৩ মে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’। সেই ধারা আজও সমান বেগে বহমান। কালের নিয়মে অসংখ্য পত্র-পত্রিকা আত্মপ্রকাশের শুভ সূচনা করে বিলীন হয়ে গেছে, শুধু রয়ে গেছে তাদের অমূল্য রচনার রত্নসম্ভার। স্বামী বিবেকানন্দ প্রবর্তিত ‘উদ্বোধন’ পত্রিকা আগামী জানুয়ারিতে ১২৫ বর্ষে পদার্পণ করবে। তারই প্রাক্‌মুহূর্তে আমরা মনোনিবেশ করেছি সেই সমস্ত বিস্মৃত পত্রিকার পাতায়। গবেষক বিজন ঘোষাল অসীম মন নিয়ে তুলে আনছেন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ পরিমণ্ডলের নানান প্রাসঙ্গিক রচনা, যা আমাদের সমৃদ্ধ করবে।—সম্পাদক
স্বামী বিবেকানন্দের স্থূলদেহ ত্যাগ করার প্রায় এগারো বছর পর ‘প্রবাসী’র বৈশাখ ১৩২০ (১৩ বর্ষ, ১ম খণ্ড, ১ম সংখ্যা)-এ ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ বিভাগে (পৃঃ ১১৩-১১৪) সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক লিখিত।

ভারতবর্ষকে গভীরভাবে অনুধাবন করার জন্য ১৯৯৮ সালে সিস্টার নিবেদিতা (Margaret Elizabeth Nobel : 1867—1911) স্বামীজীর সঙ্গে ভ্রমণে বের হন। ভ্রমণের অভিজ্ঞতাজাত রচনাগুলি নিবেদিতার প্রয়াণের পর ১৯১৩ সালে স্বামী সারদানন্দজীর সম্পাদনায় ‘Notes of Some Wanderings with the Swami Vivekananda’ শিরোনামে ব্রহ্মচারী গণেন্দ্রনাথ কর্তৃক উদ্বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থশেষে সম্পাদকের অভিমত সম্বলিত হয়ে বারোটি অধ্যায়ে গ্রন্থটি বিন্যস্ত। অধ্যায়ের শিরোনামগুলি হলো যথাক্রমে—

  1. The Home on the Ganges,
  2. At Naini Tal and Almora,
  3. Morning Talks at Almora,
  4. On the way to Kathgodam,
  5. On the way to Baramulla,
  6. The Vale of Kasmir,
  7. Life at Srinagar,
  8. The Temple of Pandrenthan,
  9. Walks and Takhs beside the Jhellum,
  10. The Shrine of Amarnath
  11. At Srinagar on the Return Journey
  12. The Camp Under the Chennaars

স্বামী বিবেকানন্দের সহিত ভ্রমণ

ভগিনী নিবেদিতা প্রভৃতি শিষ্যগণ ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দের সহিত উত্তর ভারতে ভ্রমণ করেন। তৎসম্বন্ধে ভগিনী নিবেদিতার লিখিত একখানি বহি* অল্পদিন হইল প্রকাশিত হইয়াছে। সম্প্রতি বেশী অবসর না থাকায় মনে করিয়াছিলাম বহিখানির দুই চারি পাতা পড়িয়া দুই চারি ছত্র লিখিয়া দিব। কিন্তু একবার পড়িতে আরম্ভ করিয়া শেষ করিয়া ফেলিলাম। বহিখানি পড়িয়া মনে হইল, এরূপ এক জন অসামান্য ব্যক্তির সহিত ভারত-ভ্রমণ কি সৌভাগ্য। একটিও তুচ্ছবিষয়ক কথা নাই, সমস্তই উচ্চ জীবনের কথা। অথচ বহিখানি নীরস নয়। নির্মল আনন্দে ভরা। যেমন সুন্দর ভাষা, ভাবে চিন্তায়

তেমনি বিচিত্র। সচরাচর এইরূপ দেখা যায় যে মানুষ মনে করে যে যাহার সঙ্গে সম্পূর্ণ মতের মিল নাই, কেমন করিয়া তাহাকে প্রীতি শ্রদ্ধা ভক্তি দেওয়া যায়? কিন্তু একজন মানুষের সঙ্গে কোনও আর একজনের সব বিষয়ে মত এক হইবে, ইহা অসম্ভব। ইহা আশা করাই অনুচিত। সত্য শিব সুন্দরের অনন্ত রূপ, শক্তির অনন্ত বিকাশ; ইহার সমস্তটা কোন মানুষই দেখিতে পায় না; সকলে ঠিক্ একই অংশও দেখে না। তাই বাস্তবিক যাঁহারা সত্যদ্রষ্টা, কর্মী ও ভাবুক, তাঁহারা, মতের মিল না থাকিলেও, অপর সত্যদ্রষ্টা কর্মী ও ভাবুকদের মর্য্যাদা বুঝেন ও সম্মান করেন। এইজন্য, দেখিতে পাই, বিবেকানন্দ সকল সম্প্রদায়ের লোকেরই গুণগ্রাহী ছিলেন। তিনি হিন্দুধৰ্ম্মকে ক্রিয়াশীল, অধর্ম্মের সহিত সমরপন্থী এবং দীক্ষা দ্বারা অহিন্দুকেও নিজ ক্রোড়ে আশ্রয় দানে যত্নবান্‌ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি নিজে মুসলমানের, সকল জাতির, অন্ন ও জল গ্রহণ করিতেন, এবং স্পৃশ্যাস্পৃশ্য বিচারের ঘোর বিরোধী ছিলেন।

       বুদ্ধদেব তাঁহার প্রধান শিষ্য আনন্দকে এই মৰ্ম্মে উপদেশ দিয়াছিলেন, “তোমরা নিজেই নিজের আলোক হও; নিজের চেষ্টার দ্বারা নিজের মোক্ষ সাধন কর।” বিবেকানন্দও ভারতবাসীর অন্তর্নিহিত শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। চেষ্টা বিফল হয় নাই।

সম্পাদক [প্রবাসী]