শারদোৎসব বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। পূজার কয়েকদিন আমরা নতুন করে সেজে উঠি। আত্মীয়স্বজন যিনি যেখানেই থাকুন না কেন, এই পূজার সময় মিলিত হন একসাথে। তাই দুর্গোৎসব মিলনোৎসবও বটে। বারোয়ারি পূজা ছাড়াও বহু বাড়িতে সাড়ম্বরে পালিত হয় এই মহোৎসব। কলকাতা ছাড়াও বঙ্গের বিভিন্ন জেলার বহু বর্ধিষ্ণু পরিবারে দুর্গাপূজা হয় মহা ধুমধাম করে ও নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে। আজ সেইরকম ছয়টি পরিবারের পূজা সম্পর্কে আলোকপাত করব, যেগুলো আমার কাছে ব্যতিক্রমী দুর্গাপূজা বলে মনে হয়েছে়। বিগত কয়েক বছর এইরকম বেশ কয়েকটি পরিবারের দুর্গাপূজা স্বচ‌ক্ষে দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। সেগুলোর থেকে ছয়টি পূজা সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করব। এই পারিবারিক পূজাগুলি হাওড়া ও হুগলি জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ।


হাওড়া জেলার মহিয়াড়ি কুণ্ডুচৌধুরী বাড়িতে দুর্গাপূজার বয়স দুশো বছরেরও অধিক। এখানে দেবী দুর্গা পূজিত হন হরগৌরীরূপে। তাই দেবী এখানে দশভুজা মহিষাসুরমর্দিনী সিংহবাহিনী নন, বরং তিনি তাঁর স্বামী শিবের বাঁদিকে বিরাজমান। এই শান্ত মূর্তি এককথায় অসাধারণ। অবশ্য দেবীর সঙ্গে আছেন তাঁর পুত্র-কন্যারা—গণেশ, কার্তিক, ল‌ক্ষ্মী ও সরস্বতী।


এই পরিবার বঙ্গের কয়েকটি পরিবারের মধ্যে এমন একটি পরিবার, যেখানে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয় দুবার—চৈত্রে বাসন্তীপূজা ও আশ্বিনে দুর্গাপূজা। দুটি পূজাই অনুষ্ঠিত হয় এঁদের পাঁচ খিলানবিশিষ্ট ঠাকুরদালানে, যেটি দেখার মতো। দুর্গাপূজা এখানে পালিত হয় বৈষ্ণব মতে। পূজার কয়েকদিন কুমারীপূজা অনুষ্ঠিত হলেও বাসন্তীপূজার সময় তা খালি একবারই হয়। অন্যান্য পরিবারের মতো ধুনো পোড়ানোর রীতি আছে এই পরিবারেও। বাতাবিলেবু বলিদান হিসাবে ব্যবহৃত হয় দুর্গাপূজায় ও তরমুজ বাসন্তীপূজায়।


একসময় এই পরিবারের ব্যবসা মূলত ছিল নুনের এবং সেই সময়ে সরস্বতী নদী প্রবহমান ছিল। কাঠামোপূজা অনুষ্ঠিত হয় উলটোরথের দিন। কাঠামো তৈরি শেষ হলে জন্মাষ্টমীর দিন থেকে তাতে মাটি লাগানোর কাজ শুরু হয়। এই পূজার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো যে, পূজার কয়েকদিন পরিবারের সদস্যরা নিরামিষ আহার করেন। দশমীর দিন দেবীকে ঠাকুরদালান থেকে নামিয়ে আনার পর এঁরা মৎস্যমুখ করেন। এই পরিবারের গৃহদেবতা হলেন ল‌ক্ষ্মীজনার্দন। এছাড়া দালানের বাইরে আছে দুটি জোড়া আটচালা রীতির শিবমন্দির। এই মন্দিরগুলির বয়স দুশো পার। দুর্গাপূজা ছাড়াও এখানে দোলযাত্রা, রথযাত্রা ও রাসযাত্রা সাড়ম্বরে পালিত হয়।


হাওড়া জেলায় দেখা আরো একটি ব্যতিক্রমী দুর্গাপূজা হলো শিবপুরের পালবাড়ির অভয়া দুর্গা। পূজা যে কবে শুরু হয়েছে তা সঠিক জানা না থাকলেও এই পালবাড়ির পূজা প্রায় তিনশো বছরের পুরানো। বিখ্যাত ঔষধ-ব্যবসায়ী বটকৃষ্ট পালের পারিবারিক পূজা হিসাবে খ্যাত এই পূজা এখনো নিয়মনিষ্ঠার সঙ্গে সাড়ম্বরে পালিত হয়। দেবী এখানে পূজিত হন অভয়ারূপে। তাই এই মূর্তিতে কোনো রূঢ় ভাব নেই, বরং আছে বরাভয়দাত্রী ভাব। দেবীর দুই হাতের একটিতে একখানি ফোটা পদ্ম ও ফল এবং আরেকটি হাতে তিনি আশীর্বাদ প্রদান করছেন। মায়ের এই শান্তরূপ সত্যি দেখার মতো। এই মূর্তিতে নেই কোনো অসুর।


রথযাত্রার দিন কাঠামোপূজা হয় ও ঠাকুরদালানেই তৈরি হয় মূর্তি। এখানে বোধন হয় ঠাকুরঘরে কৃষ্ণা নবমী তিথিতে। নিয়মিত চণ্ডীপাঠ চলে মহানবমী অবধি। কাছাকাছি গঙ্গা থাকা সত্ত্বেও নবপত্রিকা-স্নান করানো হয় বাড়িতে। পূজা হয় শাক্ত মতে। বলিদানের রীতি আছে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে। এর মধ্যে নবমীতে মোষবলি দেওয়া হয়। তান্ত্রিক মতে সন্ধিপূজা অনুষ্ঠিত হয়। ধুনো পোড়ানোর রীতি মহাষ্টমীর দিন পালন করা হয় এবং সেই সময় শুধু যে পরিবারের মহিলা সদস্যরা অংশগ্রহণ করতে পারেন তা নয়, পাড়ার মহিলারাও তাতে অংশ নেন। যে-দালানে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়, তার বয়স ও বাড়িটির বয়স প্রায় কাছাকাছি। পূজা উপল‌ক্ষে দালানে সাদারঙের প্রলেপ পড়ে।


হুগলি জেলার অনেক পরিবারের দুর্গাপূজা বেশ প্রাচীন ও কয়েকটি পূজা ব্যতিক্রমী বলে মনে হয়। হুগলি জেলার দুর্গাপূজা পরিক্রমা শুরু করছি শ্রীরামপুর মহকুমার অন্তর্গত জনাইয়ের বাকসা গ্রামের চৌধুরীবাড়ির পূজা দিয়ে। খুবই সুন্দর এক ঠাকুরদালানের সম্মুখভাগ স্বাগত জানায় দেবী দুর্গা দর্শনের জন্য। এই সম্মুখভাগ এমনভাবে তৈরি যে, প্রতিিট দ্বারের দুধারে দুটি করে জানলা। এখানে আছে মোট তিনটি দরজা ও আটটি জানলা। এর মধ্যে মাঝের দরজাটি মূল প্রবেশদ্বার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এটির দুই পাশে আবার বসার সুবন্দোবস্ত আছে।


এই পূজার বয়স দুশো পার হয়ে গেছে। রাজা রাম চৌধুরীর হাত ধরে এই পূজার শুরু। দালানটি পূজার সমসাময়িক কালে তৈরি হয়েছে। এই পূজা অনেক অংশেই ব্যতিক্রমী। পরিবারের এক সদস্যের কাছ থেকে জানলাম—প্রথমত, মা এখানে চতুর্ভুজা। দেবীর হাতে রয়েছে ঢাল, তরোয়াল, ত্রিশূল ও লেজ-ধরা সর্প। দ্বিতীয়ত, জয়া ও বিজয়ার পরিবর্তে এখানে অধিষ্ঠান করছেন রাধা ও কৃষ্ণ। কৃষ্ণ আছেন গণেশের ওপর এবং রাধা আছেন কার্তিকের ওপর। এঁরা এমনভাবে রয়েছেন যে, বলিদান তাঁরা দেখতে পান না। তৃতীয়ত, মহাষ্টমীর দিন এখানে কল্যাণীপূজা অনুষ্ঠিত হয় পরিবারের সদস্যদের কল্যাণে। চতুর্থত, বিসর্জনের সময় পুরানো দিনের রীতি মেনে দুটি মশাল জ্বলে। বলিদানের রীতি থাকলেও বর্তমানে শুধু ফল বলি দেওয়া হয়ে থাকে। পূজা হয় এখানে শাক্ত মতে। এই পূজা সম্পর্কে আরো জানতে পারি যে, সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিনদিনই কুমারীপূজা হয়। দেবীমূর্তি এখানে হরিদ্রাবর্ণা। এই মূর্তি নন্দোৎসবের পরদিন থেকেই ঠাকুরদালানে তৈরি হয়।


শ্রীরামপুরের দে-বাড়ির পূজা শুরু হয় রামচন্দ্র দের হাত ধরে ১৭৪৮ সাল থেকে। এই সুবিশাল ঠাকুরদালানে নিখুঁত পঙ্খের কাজ চোখে পড়বে, যা অবশ্যই পুরানো দিনের হারানো ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেবে। এই পূজায় বেশ কয়েকটি ব্যতিক্রম চোখে পড়ে, ষষ্ঠীর দিন পরিবারের মহিলারা দেবীকে স্বাগত জানান। দ্বিতীয়ত, নবমীর পুষ্পাঞ্জলি সীমাবদ্ধ আছে পরিবারের বিবাহিত সদস্য-সদস্যাদের জন্য; যদিও পূজার অন্যান্য দিনে এই নিয়ম বলবৎ নয়। আরেকটি বিষয় হলো যে, দেবীপূজায় যা নিবেদন করা হয়ে থাকে তা সবই গৃহে প্রস্তুত করা, একটিও বাইরের নয়। কুমারীপূজা ও ধুনো পোড়ানোর রীতি মেনে চলা হয় অষ্টমীর দিন।


দে পরিবারের গৃহদেবতা হলেন শ্রীধর জীউ। পূজার কয়েকদিন দেবী দুর্গার সাথে তাঁরও পূজা করা হয়। এখানে বৈষ্ণব রীতি মেনে পূজা হয়। আগে বিসর্জনের সময় দেবীকে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়ার রীতি থাকলেও বর্তমানে ট্রলির সাহায্যে গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়।


পরিবারের এক সদস্যের কাছ থেকে জানতে পারি যে, পূর্বে শ্রীরামপুরে যখন ড্যানিশ উপনিবেশ ছিল সেই সময় বেশ কয়েকজন ড্যানিশ সাহেব পূজা দেখতে আসতেন। এমনকী শোনা যায়, উইলিয়াম কেরীও নাকি একবার এখানে এসেছিলেন পূজার সময়।


আরেকটি প্রাচীন ও ব্যতিক্রমী দুর্গাপূজা হলো চন্দননগরে খলিসানীর বসু বাড়ির পূজা। এই পূজা শুরু করেন করুণাময় বসু আনুমানিক ৯১৪ বঙ্গাব্দে (১৫০৭ সালে)। আবার দুর্গাপূজা শুরুর আটবছর আগে ৯০৬ বঙ্গাব্দে করুণাময় বসু কর্তৃক শ্রীশ্রীবিশালা‌ক্ষী মাতার মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। বসুরা ছিলেন এই অঞ্চলের জমিদার। পরিবারের এক বয়স্ক সদস্যের মতে, বর্তমান দালানটি অনেকবার সংস্কার হওয়ার ফলে ফুলের নকশাগুলি সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগে হোগলাপাতার চাল ছিল। বর্তমানে ঠাকুরদালানটি যেখানে অবস্থিত, সেখানে নাকি আগে পূজা হতো। এত প্রাচীন পূজা খুব একটা চোখে পড়ে না।


পূজা অনুষ্ঠিত হয় সম্পূর্ণ বৈষ্ণব রীতি মেনে। জন্মাষ্টমীতে কাঠামোপূজার মাধ্যমে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। এখানে একটি ব্যতিক্রমী বিষয় হলো যে, মৃৎশিল্পী, ঢাকি এবং পুরোহিতরা দুশো বছরের অধিক বংশপরম্পরা ধরে এই পূজার সাথে যুক্ত। যখন দুর্গাপূজা প্রথম শুরু হয়, তখন সরস্বতী নদী প্রবহমান ছিল। প্রাচীন রীতি মেনে আজও তাই সরস্বতীর নদীর তীরে নবপত্রিকার স্নান করানো হয়। তৃতীয়ত, এই প্রতিমা তৈরিতে আছে বিশেষত্ব। তিন চালাবিশিষ্ট এই দেবীপ্রতিমায় জঁাকজমক কিছুটা হ্রাস পেলেও প্রাচীন ঐতিহ্য ও প্রথাকে বজায় রেখে এখনো এই পরিবার পূজা করে চলেছে। এখানে বোধন হয় মহালয়ার পরের দিন। পূজায় অন্নভোগ দেওয়া হয় না; পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের নৈবেদ্য দেবীকে নিবেদন করা হয়। বসু পরিবারের গৃহদেবতা হলেন মদনমোহন। প্রাচীনকালে পূজার দিনগুলোতে যাত্রা হতো। অন্যান্য বনেদি পরিবারের মতো কুমারীপূজা ও ধুনো পোড়ানোর রীতি চালু আছে মহানবমীতে। এই পূজার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো যে, এটি পাঁচ শতাব্দীরও বেশি স্মৃতি বহন করে চলেছে।


চুঁচুড়ার সাগরলাল দত্তের ঠাকুরবাড়ির পূজা শুরু হয় ১৮৬২ সাল থেকে। দেবী দুর্গা এখানে পূজিত হন অভয়ারূপে। দেবীর দুই হাতে বর ও অভয় মুদ্রা। নেই কোনো অস্ত্র। দেবীর সাথে আছেন ল‌ক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশ। প্রতিমা এখানে একচালা।


এখানে কাঠামোপূজা হয় রথযাত্রার দিন। প্রতিমা-শিল্পী এখানে বংশপরম্পরা ধরে প্রতিমা গড়ে আসছেন। মহালয়ার পর প্রতিপদে দেবীর ঘট বসে। এই পূজা সম্পূর্ণ বৈষ্ণব রীতি মেনে অনুষ্ঠিত হয় বলে কোনো বলিদানের ব্যবস্থা নেই। পরিবার সূত্রে জানতে পারি যে, অষ্টধাতুর তৈরি একটি অভয়া মূর্তি এক সন্ন্যাসী দিয়ে যান। সেই থেকে এই মূর্তি নিত্য পূজিত হচ্ছেন। পূজার কটা দিন সেই দেবীমূর্তি ঠাকুরঘর থেকে দালানে নামিয়ে এনে মা অভয়া মৃন্ময়ী মূর্তির সাথে পূজা করা হয়। পূজার তিনদিনই হয় হোম। এর মধ্যে ধুনো পোড়ানোর রীতি সাড়ম্বরে অষ্টমীর দিন পালিত হয়।


প্রতিমা বিসর্জনের ক্ষেত্রে এই পরিবার স্বতন্ত্রতা বজায় রাখে। কোনো গাড়ি করে নয়, প্রতিমাকে কাঁধে করে গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয়।

‘রাজেন্দ্রলাল দে স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।
সহকারী শি‌ক্ষক, পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউশন