‘উদ্বোধন’-এর গত শ্রাবণ ১৪২৯ সংখ্যায় ‘ভারতীয় মার্গসংগীতে বর্ষা’ পড়ে ভাল লাগল। আমার দেখা একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। সেটি এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করছি। সময়টা ১৯৭৩ সালের জুলাই মাস, আষাঢ়ের শেষ সপ্তাহ। তখন থাকতাম হুগলি জেলার পাণ্ডুয়া থানার অন্তর্গত বেলুন গ্রামে। একবার কলকাতা থেকে গ্রামে এলেন শ্রদ্ধেয় কামা‌ক্ষ্যা ঘোষ। তিনি আকাশবাণীতে সুরকার হিসাবে নাম করেছিলেন। বেলুন গ্রামে তাঁর দিদির বাড়ি। তখন অবশ্য তাঁর দিদি বেঁচে নেই। এখানে এসে কামা‌ক্ষ্যাবাবু প্রায়দিনই গান গাইতেন, বাঁশি বাজাতেন। প্রতিদিনই উনি কিছুটা করে ‘কথামৃত’ পড়তেন, তারপর আমায় পড়তে দিতেন। এই সময় পাঁচ-সাত জন প্রতিবেশী সেই আসরে উপস্থিত হতেন।

ঘটনা হচ্ছে, ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে অল্প দু-একদিন বৃষ্টি হলেও এপ্রিল, মে, জুন মাসে বৃষ্টি তো দূরস্থান, মেঘের দেখাও মেলেনি। গ্রামে সেই বছরেই প্রথম নলকূপের কোনোটাতেই জল পাওয়া গেল না। অর্ধেক পুকুর জলশূন্য, ফুটিফাটা। কোনো কোনো পুকুরে জল থাকলেও খাওয়ার অবস্থায় নেই। একটা নামকরা কালীমন্দির এই বেলুন গ্রামে আছে, নাম—‘হ্যাঁপা কালী’। পাতকুয়া কাটিয়ে মহিলারা গৃহে সন্ধ্যা-দীপ দেওয়ার আগে হ্যাঁপা কালী মায়ের দুয়ারে ঘড়া ঘড়া জল ঢেলে প্রার্থনা জানাচ্ছিলেন বৃষ্টিপাতের জন্য।

ঐ সময় বেশ কিছু মানুষ হ্যাঁপা মাকে প্রণাম জানাতে যেত। তেমনি একদিন আমি ও কামা‌ক্ষ্যাবাবু গিয়েছি। ঘড়ায় করে জল ঢালা দেখে কামা‌ক্ষ্যাবাবু জানতে চাইলেন—কী হচ্ছে? আমি বললাম—মানুষ বৃষ্টিপাতের জন্য খুবই কাতর হয়ে পড়েছে, প্রায় হাহাকার অবস্থা। সব শুনে উনি বললেন: “কাল বৃষ্টি নামাব।” আমি শুনলাম, কিন্তু বুঝলাম না। জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পেলাম না। যে যার বাড়ি ফিরলাম।

পরের দিন বিকাল ৩টা নাগাদ কামা‌ক্ষ্যাবাবু আমাকে ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখি, তিনি তাঁর ঘরের দুয়ারে মাদুরে বসে বড় একটা আড় বাঁশি নিয়ে বাজাচ্ছেন, আরেকটা বাঁশি পাশে রয়েছে। আমাকে ইশারায় বললেন পাশে বসতে। শুনলাম, সকাল থেকে একইভাবে উনি বাঁশি বাজিয়ে বাজাচ্ছেন। সকালে চা খাননি, দুপুরেও স্নান-খাওয়া করেননি। কারো সাথে কথা বলছেন না, উঠছেনও না। প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে, উঠে দাঁড়ালাম। কামা‌ক্ষ্যাবাবু ইশারা করাতে বসতে হলো। ছয়টা বাজল। একনাগাড়ে শুধুই বাঁশির শব্দ। প্রায় সাড়ে ছয়টা; ঈশান কোণে মেঘ ও বিদ্যুতের ঝিলিক দেখা গেল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। বিদ্যুতের ঝলকানি বাড়তে লাগল; টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো। পৌনে সাতটা, কামা‌ক্ষ্যাবাবু বাঁশি সরিয়ে মৌন ভঙ্গ করে প্রথমবার বললেন : “বলেছিলাম—কাল বৃষ্টি নামাব।” একটাই কথা, আবার চুপ। কিন্তু বৃষ্টি ও বিদ্যুতের চমক বাড়তে লাগল। আমি কোনো কথা
না বলে দ্রুত বাড়ি ফিরলাম। বৃষ্টি ক্রমে প্রবল হতে থাকল। রাত যত গভীর হলো, বৃষ্টি যেন তত তীব্র হতে লাগল।

দিনের আলো ফুটতে দেখা গেল, রাস্তা-ঘাট, পুকুর-ডোবা, মাঠ সবই জলে জলময়! হাত-মুখ ধুয়ে কিছু পরে কামা‌ক্ষ্যাবাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখি, উঠানের পাঁচ-সাত জায়গায় মাটি ফুঁড়ে ফিনকি দিয়ে জল উঠছে। পাতকুয়ায় জল তুলতে দড়ির দরকার হচ্ছে না, শুধু বালতিতে জল তোলা যাচ্ছে। কামা‌ক্ষ্যাবাবুর সাথে দেখা হতে বললেন : “এর নাম ‘মেঘ-মল্‌হার’। এই রাগের ক্ষমতা আছে, যেকোনো জায়গা থেকে মেঘকে টেনে নিয়ে আসার।” ওনার কথা শুধু আমিই শুনলাম, জানলাম। অন্যরা কিছু জানলেন না, বুঝলেন না। এই কাহিনি সাধারণভাবে মানুষকে বলা যায় না। হয়তো বিশ্বাস করবে না। কিন্তু এটা সত্য ঘটনা, স্বচ‌ক্ষে দেখা। এবং বইতে লেখা ঐ রাগের মাহাত্ম্য একশো ভাগ সত্য।

নৃসিংহ প্রসাদ দে
সোনারগ্রাম, পাণ্ডুয়া , হুগলি