।।৪।।
দেহ-চেতনাকে রামকৃষ্ণ-চেতনায় রূপান্তর
আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে প্রধান বাধাগুলোর অন্যতম হলো আমাদের দেহ-মনের চেতনাকে রামকৃষ্ণ-চেতনাতে রূপান্তরিত করার বাধা। যাঁদের পরিবার নেই, কোনো সাংসারিক কর্তব্যকর্মও করতে হয় না—সেই সন্ন্যাসীদেরও দেহচেতনা আত্মচেতনার পথে প্রবল বাধা হতে পারে। স্বামীজীর ‘কর্মযোগ’-এর একটি মন্তব্য এপ্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে—“যে-মানুষ গৃহে থাকে না, ভাল পোশাক পরে না, ভাল খাবার খায় না, সাধনার জন্য মরুভূমির মতো নির্জন অঞ্চলে চলে যায়—তার একমাত্র সম্পদ হলো তার নিজের শরীর এবং সেই শরীরেও তার প্রবল আসক্তি থাকতে পারে, শরীর রক্ষা ও প্রতিপালনের জন্য সে সবসময় নিযুক্ত থাকতে পারে।”৬৮ অর্থাৎ নিজের শরীরের প্রতি তীব্র আসক্তিই তার আত্মচেতনার প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
নিজের দেহ-মনের প্রতি এই যে তীব্র আত্মবোধ বা আসক্তি, একে কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়—এই প্রশ্ন সকল সাধকেরই। এই প্রশ্নের একটি ফলপ্রসূ সমাধান হলো দেহতে ‘আত্মবোধ’ না করে ‘রামকৃষ্ণবোধ’ করা। এপ্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবস্থায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশে যা বলেছিলেন তা স্মরণযোগ্য—“(হে কৃষ্ণ!) তুমিই অখণ্ড, তুমিই আবার চরাচর ব্যাপ্ত করে রয়েছ! তুমিই আধার। তুমিই আধেয়! প্রাণকৃষ্ণ! মনকৃষ্ণ! বুদ্ধিকৃষ্ণ! আত্মাকৃষ্ণ! প্রাণ হে গোবিন্দ মম জীবন!”৬৯ তদনুযায়ী আমরাও পুনঃপুন ভাবব, পুনঃপুন ধারণা করার চেষ্টা করব যে, আমাদের দেহের প্রত্যেকটি কোষের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ অনুস্যূত হয়ে আছেন; আমাদের প্রাণশক্তি হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ; চক্ষু, কর্ণ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গুলিও শ্রীরামকৃষ্ণ। শুধু তাই নয়, আমরা ভাবতে পারি—আমাদের ইন্দ্রিয়ের বিষয়গুলিও শ্রীরামকৃষ্ণ। আমরা চোখ দিয়ে যা দেখি, কান দিয়ে যা শুনি, জিভ দিয়ে যা আস্বাদন করি—সেগুলিও শ্রীরামকৃষ্ণ। মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর প্রভৃতি দেহস্থ সূক্ষ্ম সাতটি চক্রে শ্রীরামকৃষ্ণ অবস্থান করছেন। আমাদের চেতন, অবচেতন ও অতিচেতন মন শ্রীরামকৃষ্ণ; বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকারও শ্রীরামকৃষ্ণ, সর্বোপরি আমাদের আত্মাও শ্রীরামকৃষ্ণ—যাকে লক্ষ্য করে স্বামীজী ‘আত্মারাম’ শব্দটি চয়ন করেছিলেন। এই পদ্ধতিতে আমরা আমাদের সত্তার প্রত্যেক স্তরকে রামকৃষ্ণায়িত করে তুলতে পারি। দীর্ঘদিন আন্তরিকতার সঙ্গে এজাতীয় অনুশীলন জন্ম-জন্মান্তর ধরে আমাদের মনের গভীরে দেহবোধের যে দৃঢ় সংস্কার বর্তমান, তাকে রামকৃষ্ণ-বোধে রূপান্তরিত করবে।
সর্বভূতে শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন
শ্রীরামকৃষ্ণ সকল জীবের মধ্যে বিরাজ করছেন—যাদের সঙ্গে বাস করি, যাদের আমরা পছন্দ করি শুধু তারাই নয়, যাদের আমরা পছন্দ করি না তাদের মধ্যেও তিনি আছেন—ভাল-মন্দ, পাপী-পুণ্যবান, দেশি-বিদেশি, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল জীবের মধ্যে তাঁর অবস্থান। শুধু তাই নয়, সমস্ত জড়বস্তুর মধ্যেও তিনি, পবিত্র-অপবিত্র সবকিছুর মধ্যেও তিনি। “শুচি অশুচিরে লয়ে দিব্য ঘরে কবে শুবি।/ যখন দুই সতীনে পিরিত হবে, তবে শ্যামা মাকে পাবি।”৭০ কেউ বলতে পারেন—আমরা যখন শ্রীরামকৃষ্ণকে সকলের মধ্যে, সবকিছুর মধ্যে প্রত্যক্ষ করছি না, তখন তাঁকে তাদের মধ্যে কল্পনা করব কেন? কিন্তু এটি কি সত্য নয় যে, আমাদের মন কল্পনাবিলাসী এবং সেসব কল্পনার অধিকাংশই মিথ্যা অর্থাৎ যেগুলির পারমার্থিক অস্তিত্ব নেই? যখন আমরা সবকিছুর মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণকে ধারণা করার কথা বলছি, প্রাথমিকভাবে সেই ধারণা কল্পনা মনে হলেও যত আমরা রামকৃষ্ণ-চেতনার সাধনা করব ততই আমরা হৃদয়ঙ্গম করব যে, সর্বজীবে ও সর্ববস্তুতে শ্রীরামকৃষ্ণের বিদ্যমানতা কল্পনা নয়, পরমার্থত সত্য।
স্বামী শিবানন্দজীর অনুভব এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। বেলুড় মঠে একদিন তিনি তাঁর সেই অনুভব বর্ণনা করে বলছেন : “ঠাকুর কৃপা করে জানিয়েছেন, তাই জেনেছি। তিনিই সব—সবই তিনি।” “এই যে গাছপালা, আকাশ, গঙ্গা, ঘর-বাড়ি যা কিছু সবই তিনি। এই ঠাকুর ছাড়া আর কিছু নেই। আমরা তাঁকে জেনেছি। তিনি না জানালে তাঁকে কেউ জানতে পারে না। আমাকে কৃপা করেছেন তাই জেনেছি।”৭১ “কীটপতঙ্গ জড় অণু পরমাণু সবই চৈতন্য। তারই নাম ঠাকুর। তিনি সব জুড়ে আছেন। তিনি ছাড়া আর কিছু নেই। তিনি দয়া করে এসেছিলেন জগতের উদ্ধার করতে। কৃপা, কৃপা, কৃপা।” “তিনি ছাড়া আমাদের আলাদা সত্তা কিছু নেই। তিনিই আছেন এই শরীরের মধ্যে এবং বাইরে—একমাত্র তিনিই—তিনি।”৭২
এখন এই ধারণার অভ্যাস আমরা কীভাবে করতে পারি? আমরা যখন বাসে, গাড়িতে বা হেঁটে বাইরে বেরই তখন লোকজন, দোকান, বাড়ি, গাড়ি ইত্যাদি দেখি। এই দেখার সময় মানুষকে মানুষ, দোকানকে দোকান, বাড়িকে বাড়ি এবং গাড়িকে গাড়ি হিসাবেই দেখি। এখন আমাদের এই দৃষ্টিটাকে পরিবর্তন করে তাদের সবকিছুর মধ্যে ঠাকুরকে দেখা অভ্যাস করতে হবে। “যত্র যত্র নেত্র পড়ে, তত্র তত্র কৃষ্ণ স্ফূরে।” “ত্বং স্ত্রী ত্বং পুমানসি ত্বং কুমার উত বা কুমারী।/ ত্বং জীর্ণো দণ্ডেন বঞ্চসি ত্বং জাতো ভবসি বিশ্বতোমুখঃ।।”৭৩ এই অভ্যাস আমাদের দুভাবে সহায়তা করবে। প্রথমত, এটি আমাদের মন ও ইন্দ্রিয়গুলিকে ভোগসংকুল পরিবেশেও চঞ্চল হওয়া থেকে বিরত করবে। দ্বিতীয়ত, আমরা আপাতদৃষ্টিতে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্করহিত ঐহিক পরিবেশের মধ্যেও শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সংযোগরক্ষা করে মনকে স্থির রাখতে পারব।
জয়রামবাটীর শ্রীশ্রীমায়ের বাড়িতে বেশ কয়েকটি বিড়াল থাকত, মা তাদের খাওয়াতেন। একবার কলকাতায় যাওয়ার আগে মা তাঁর অনুপস্থিতিতে জ্ঞান মহারাজের ওপর ঐ বিড়ালগুলিকে দেখাশোনার ভার দিলেন। কিন্তু জ্ঞান মহারাজ যে বিড়াল পছন্দ করেন না, তা মা জানতেন। প্রথমে তিনি তাঁকে বুঝিয়ে বললেন : “জ্ঞান, বেড়ালগুলোর জন্যে চাল নেবে; যেন কারও বাড়ি না যায়—গাল দেবে, বাবা।” এভাবে বোঝালেও জ্ঞান মহারাজ তা ঠিক মেনে নিতে পারছিলেন না বুঝে শেষে বললেন : “দেখ, জ্ঞান, বেড়ালগুলোকে মেরো না। ওদের ভেতরেও তো আমি আছি।”৭৪ একথাটা জ্ঞান মহারাজের মনে এতই লাগল যে, তখন থেকে তিনি বিড়ালগুলোকে শুধু ভালভাবে দেখাশোনা করতেন তাই নয়, নিজে নিরামিষাশী হলেও বিড়ালগুলি মাছ খেতে ভালবাসে বলে তাদের জন্য মাছের জোগাড়ও করতেন। শুধু বিড়াল নয়, শ্রীশ্রীমা যে সর্বপ্রাণীর মধ্যে বিরাজিতা, তা তাঁর বিভিন্ন উক্তি থেকে আমরা জানতে পারি। অনুরূপভাবে শ্রীরামকৃষ্ণও সর্বপ্রাণীতে ও সর্ববস্তুতে বিরাজমান। শ্রীশ্রীমায়ের দীর্ঘদিনের সেবক স্বামী পরমেশ্বরানন্দ স্মৃতিচারণা করে লিখেছেন : “একদিন দেখিলাম, (মা) পূজার পূর্বেই নৈবেদ্য হইতে হালুয়া লইয়া ‘গঙ্গারাম (মায়ের বাড়ির পোষা টিয়াপাখি), খাও বাবা’ বলিয়া খাওয়াইতেছেন। আমি তাড়াতাড়ি বলিলাম, মা, এখন পূজা হয় নি, গঙ্গারামকে হালুয়া দিলেন যে? শ্রীশ্রীমা বলিলেন, ‘বাবা, ওর ভিতরই ঠাকুর রয়েছেন।’”৭৫
রামকৃষ্ণ সংঘে আহারগ্রহণের পূর্বে গীতার এই মন্ত্রটি প্রতিদিন উচ্চারণ করা হয়—“ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্।/ ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা।।”৭৬ —ব্রহ্মবিদ হবনীয় দ্রব্যের অর্পণকে, ঘৃতকে, হোমাগ্নিকে, আহুতিদানের কর্তাকে এবং হোমক্রিয়াকে ব্রহ্মরূপে দর্শন করেন। তাঁর দৃষ্টিতে ব্রহ্মরূপ কর্মে সমাহিতচিত্ত ব্যক্তির প্রাপ্তব্য ফলও ব্রহ্ম। একইভাবে আমরা ভাবি—খাদ্যবস্তু ব্রহ্ম, খাদ্যগ্রহণ করা ব্রহ্ম, যিনি খাদ্যগ্রহণ করছেন তিনি ব্রহ্ম, খাদ্য-পরিপাকের শক্তি এবং পরিপাকের ফলও ব্রহ্ম। অর্থাৎ, খাদ্যপ্রক্রিয়ার সবটাই ব্রহ্ম। আহারের পূর্বে এই মন্ত্রটি উচ্চারণের উদ্দেশ্য—এই মন্ত্রটির অর্থ ধারণা করে আহার করা, তাহলে আহার গ্রহণের মতো শারীরিক বিষয়গুলিও আধ্যাত্মিক সাধনায় পর্যবসিত হবে। বাস্তব সমস্যা হলো, এই ধারণার অভ্যাসের সময় নিরাকার ব্রহ্মের কল্পনা করা কঠিন। কিন্তু তার পরিবর্তে আমরা যদি শ্রীশ্রীঠাকুরকে কল্পনা করে এই মন্ত্রটি ধারণা করার চেষ্টা করি, তাহলে তা আমাদের পক্ষে যেমন সহজ হবে তেমনি হবে ফলপ্রসূও। একইভাবে আমরা ভাবতে পারি যে, আমাদের সমগ্র পরিবেশ সবকিছুর মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ অনুস্যূত হয়ে আছেন। শুধু তাই নয়, যাকিছু ঘটছে তাঁরই ইচ্ছাতে হচ্ছে। এই বিষয়টি কথামৃত-এ বর্ণিত ‘তাঁতি ও রামের ইচ্ছা’ গল্পে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে ।
যখন আমরা অন্যদের সেবা করি, তখন তাদের মধ্যে ঠাকুরকে কল্পনা করে সেবা করতে পারি; কারণ বহুরূপে তিনিই আমাদের সম্মুখে বর্তমান। ভাল–মন্দ নির্বিশেষে সকলের মধ্যে ঠাকুরকে দেখার প্রয়াস পেলেও দুষ্টলোকদের থেকে আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। যেমন ঠাকুর বলেছিলেন—বাঘের মধ্যে নারায়ণ থাকলেও বাঘনারায়ণকে আলিঙ্গন করা চলে না, তাকে দূরে পরিহার করতে হয়। সত্যের পারমার্থিক ও ব্যাবহারিক—এই দুটি দিককে মনে রাখলে কর্মসংকট উপস্থিত হবে না।
আরো কিছু অন্তরঙ্গ সাধন
দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সেবক হয়ে থাকাকালে লাটু মহারাজ (স্বামী অদ্ভুতানন্দজী) প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আগে ঠাকুরের মুখ দেখতেন; যদি তাঁকে না দেখতে পেতেন, তবে চোখে হাত চাপা দিয়ে চেঁচিয়ে তাঁকে ডাকতেন : “আপুনি কুত্থায়?” লাটুর চিৎকার শুনে ঠাকুর বলতেন : “যাচ্ছি রে, যাচ্ছি।” ঠাকুর ঘরে এলে লাটু চোখ খুলে ঠাকুরকে প্রণাম করতেন।৭৭
আমরা তো এমন ভাগ্য করে আসিনি যে, ঘুম থেকে উঠেই জীবন্ত ভগবানকে দেখব, কিন্তু এও তো ঠিক—ঠাকুর ও মা বিভিন্ন প্রসঙ্গে বলেছেন, ছায়া কায়া সমান। ঠাকুর তাঁর ফটোর মধ্যেই সাক্ষাৎ বিদ্যমান। স্বামী বিজ্ঞানানন্দজী কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন : “একদিন ঠাকুর তাঁর একটি পট দেখিয়ে বললেন, ‘এঁকে ধ্যান করবে। আমি এর মধ্যে আছি’।”৭৮ সুতরাং রামকৃষ্ণ-সাধনার অঙ্গ হিসাবে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ও ঘুম থেকে উঠে ফটোতে ঠাকুরের মুখ দেখা এবং কিছু খাওয়ার আগে, তা সে যেকোনো খাদ্য-পানীয়, এমনকী ওষুধও ঠাকুরকে মনে মনে নিবেদন করা,৭৯ বাইরে কাজে যাওয়ার আগে ও ফিরে এসে তাঁকে প্রণাম করা, দিনের শুরুতে সেদিনের প্রধান কাজগুলি তাঁকে অবহিত করা, দিনের শেষে সব কাজের ফল তাঁকে সমর্পণ করা—এগুলি আমরা করতেই পারি। উপরন্তু পথে চলতে চলতে, গাড়িতে যেতে যেতে একটু জপ করে নেওয়া, কাজের ফাঁকে ফাঁকে অন্তরে রামকৃষ্ণ-চেতনার জাগপ্রদীপটা জ্বলছে কি না দেখে নেওয়া। এই ধরনের প্রাত্যহিক ছোট ছোট অভ্যাস আমাদের চেতনায় তথা জীবনের কেন্দ্রে শ্রীরামকৃষ্ণকে অধিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। অভ্যাসগুলি ছোট হলেও তাদের সামগ্রিক প্রভাব আমাদের আধ্যাত্মিক জীবন পরিপুষ্টির ক্ষেত্রে অপরিসীম। ঐ ধরনের অভ্যাস যান্ত্রিকভাবে করতে হলেও যত তা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠবে ততই শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের হৃদয় অধিকার করে বসবেন, ততই রামকৃষ্ণ-চেতনা আমাদের পক্ষে সহজ, স্বাভাবিক ও আনন্দময় হয়ে উঠবে।
ঈশোপনিষদ-এর সুপরিচিত প্রথম শ্লোকটির অর্ধাংশ হলো—‘ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।’ অর্থাৎ, জগতের সমস্ত কিছু ঐশীভাবনার দ্বারা মণ্ডিত করবে। অনুরূপভাবে উপরি-উক্ত বিভিন্ন প্রকারের অনুশীলনের দ্বারা আমাদেরও জগতের সবকিছু ঈশাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের সত্তা দ্বারা আবৃত করা তথা ‘রামকৃষ্ণায়িত’ করার সাধনায় ব্রতী হতে হবে। তাতেই আমাদের রামকৃষ্ণ-চেতনার পরিপূর্তি।
শ্রীরামকৃষ্ণের অদর্শনে অভাববোধ
আমরা ঠাকুরকে দর্শন করতে চাই, সর্বত্র তাঁর সজীব উপস্থিতি উপলব্ধি করতে চাই অথচ তা যে পারি না, তার জন্য আমাদের কি বেদনাবোধ আছে? অভাববোধ আছে? ঈশ্বরের অদর্শনজনিত বেদনা ও অভাব বোধের চরম উদাহরণ হলো দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সাধন-জীবন। আমাদের মতো সাধারণ ভক্তদের পক্ষে ঐরূপ ব্যাকুলতা সম্ভব না হলেও আমাদের জীবনে ঈশ্বরের তথা ঠাকুরের অদর্শনজনিত কোনো অভাববোধই যদি না থাকে তাহলে সেই অবস্থা নিঃসন্দেহে রামকৃষ্ণ-চেতনার প্রতিকূল। এর প্রতিকার হলো এই বিষয়ে আমাদের সচেতনতা আনা, যা রবীন্দ্রনাথের একটি গানে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে—“যদি তোমার দেখা না পাই, প্রভু, এবার এ জীবনে/ তবে তোমায় আমি পাই নি যেন সে কথা রয় মনে।/ যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই শয়নে স্বপনে।।”৮০
এই অভাববোধ ক্রমশ তীব্র হলে তা ব্যাকুলতার আকার ধারণ করে—ভগবদ্দর্শনের জন্য যার একান্ত প্রয়োজনীয়তার কথা ঠাকুর ভক্তদের কাছে বারবার উল্লেখ করেছেন। কারণ, তীব্র ব্যাকুলতা এলে তারপরই ‘অরুণোদয়’ অর্থাৎ তাঁর দর্শন হবে।
ধারণার অভাব
আমরা অনেক ঈশ্বরীয় কথা শুনি বা পড়ি, কিন্তু ঠিকমতো যে ধারণা করতে পারি না—এইটিও আমাদের সাধনজীবনের একটি প্রধান প্রতিবন্ধক। আমরা কতবার পড়ি, শুনি বা বলি—জগৎ অনিত্য। দেহ নশ্বর, আত্মা অবিনশ্বর। কিন্তু তা কি আমাদের ধারণা হয়েছে? তা যদি হতো তাহলে সামান্য বিপদেই আমরা বিচলিত হই কেন, বা ভারী কোনো অসুখের সম্ভাবনায় মৃত্যুভয়ে ভীত হই কেন? ‘ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্য’—একথা জানা থাকলেও একটু বিপদে পড়লেই আমরা যারপরনাই উদ্বিগ্ন হই কেন? কথামৃত-এ আমরা দেখতে পাই, শ্রীরামকৃষ্ণ বারবার ধারণার প্রসঙ্গ এনেছেন। কতবার কতভাবেই না বলেছেন—শুধু মুখে বললেই হবে না, ধারণা করতে হবে। “পাখোয়াজের বোল মুখে বললে কি হবে; হাতে আনা বড় কঠিন। শুধু লেকচার দিলে কি হবে; তপস্যা চাই, তবে ধারণা হবে।” আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গ আলোচনার সময় শ্রীম যদি কখনো বলতেন : “আজ্ঞা হাঁ, জানি”, ঠাকুর তৎক্ষণাৎ তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতেন : “না, শুধু জানলে হবে না—ধারণা করা চাই।”৮১ অর্থাৎ শুধু বৌদ্ধিক স্তরে নয়, আচরণে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবদ্দশায় তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্তদের মধ্যে একমাত্র যিনি তাঁর জন্মস্থান কামারপুকুর দর্শনে গিয়েছিলেন, তিনি শ্রীম। একথা জানতে পেরে ঠাকুর যেমন বিস্মিত হয়েছিলেন, তেমনি খুশিও হয়েছিলেন। শ্রীম কামারপুকুরের সবকিছু চৈতন্যময় ও মধুময়-রূপে দেখেছিলেন। কামারপুকুর ভ্রমণের বর্ণনা তিনি তাঁর কলকাতার বাসস্থলে যেসব ভক্ত সমবেত হতেন, তাঁদের বলতেন—যার মধ্যে ‘ধারণা’র একটি প্রসঙ্গ আছে। এখন তাঁর মুখ থেকে তা শোনা যাক—“অনেক কালের কথা। …কামারপুকুর গিছলাম। কালীপূজা হবে। বৃদ্ধ একজন ব্রাহ্মণ তন্ত্রধারক। আশীর উপর বয়স। আমরা ঠাকুরের ভক্ত জেনে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ‘গদাই গদাই’ করতে লাগলো। বললো, ও গদাইর ভক্ত তুমি? কি করে তার ভক্ত হলে অত পড়াশোনা করে? ও কোনও শাস্ত্র পড়ে নাই। মূর্খ।
“আমরা তখন করলুম কি? তাঁর কাছে যা শিখেছি, তার দুই একটা কথা ছেড়ে দিলাম। বললাম, চিল শকুন খুব উঁচুতে ওঠে, কিন্তু দৃষ্টি থাকে ভাগাড়ে অর্থাৎ যেখানে মরা গরু পড়ে থাকে। তেমনি পণ্ডিতগুলো। বড় বড় কথা কয় বটে, কিন্তু দৃষ্টি কামিনী কাঞ্চনে, ভোগে।…
“আর বললাম, বাজনার বোল মুখস্থ করা সহজ, কিন্তু হাতে আনা বড় কঠিন। বিষয়বাসনা ছেড়ে ভগবানকে ডাকলে তবে ধারণা হয়, হাতে আসে। পণ্ডিতগুলো কেবল মুখে মুখে বোল ঝাড়ে।
“পরে শুনলাম আমরা চলে আসার পর ঐ পণ্ডিত অনুশোচনা করেছিল। বলেছিল, তিনি ঠিক কথা বলেছেন।”৮২
আধ্যাত্মিক সত্য ধারণা করার প্রধান উপায় চারটি—জাগতিক বিষয়ে বাসনা ও আসক্তি কমানো; আধ্যাত্মিক সত্য উপলব্ধির উপায়গুলির বারংবার মনন করা ও তাদের অভ্যাস এবং আমাদের আধ্যাত্মিক আদর্শ ও জীবনচর্যার মধ্যে বৈপরীত্য আছে কি না সেবিষয়ে সদা জাগ্রত থাকা। বুদ্ধদেব তাঁর প্রিয় শিষ্য আনন্দকে বলেছিলেন : “আনন্দ! সদা জাগ্রত থেকো।” আধ্যাত্মিক সত্যগুলি ধারণা করার জন্য শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে শক্তি প্রার্থনাও ধারণা করার অন্যতম উপায়।
‘রামকৃষ্ণ-অদ্বৈত’
যে-অনুশীলনগুলির কথা ওপরে আলোচনা করা হলো, সেগুলি ‘রামকৃষ্ণ–অদ্বৈত’ তথা ভক্তিযোগের অদ্বৈতসাধনায় আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। জ্ঞানযোগে সাধক পরব্রহ্মের সাথে অভিন্নতা অনুভব করতে চান, যা অদ্বৈতবেদান্তের মূল কথা। স্বামীজীর পরিকল্পনা অনুযায়ী হিমালয়ে যে অদ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে কোনো ঠাকুরঘর নেই, শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি বা মূর্তি রাখার জন্য কোনো বেদি নেই। কারণ, সেই আশ্রম কেবলমাত্র শুদ্ধব্রহ্ম তথা অদ্বৈতবেদান্তের উপাসনার জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু ভক্তিপথে রামকৃষ্ণ–চেতনা অনুশীলনের জন্য আমরা ‘রামকৃষ্ণ-অদ্বৈত’ উপাসনাকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। স্বামী শিবানন্দজী বারাণসীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে তার নাম দিয়েছিলেন—‘শ্রীরামকৃষ্ণ অদ্বৈতাশ্রম’। এই নামকরণটি গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য যে, শ্রীরামকৃষ্ণকে সর্বত্র ও সর্বভূতে ধারণা করার প্রয়াসের সাধনা যে ঐ আশ্রমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, তার ইঙ্গিত এই নামকরণের মধ্যে নিহিত।
শ্রীরামকৃষ্ণ : দ্বৈত-বিশিষ্টাদ্বৈত-অদ্বৈত
স্বামী তুরীয়ানন্দজী জীবনের শেষদিকে কাশীতে রামকৃষ্ণ মিশনের সেবাশ্রমে থাকতেন। সেকালের একটি ঘটনার স্মৃতিচারণা করেছেন স্বামী বিজয়ানন্দ : “কাশীতে একদিন বিকালে হরি মহারাজের (স্বামী তুরীয়ানন্দজী) সঙ্গে পথে বেড়াতে গেছি। আমি একটু পিছনে পড়েছি। হরি মহারাজ দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন। আরও দুজন বাইরের সাধু চলার পথে হরি মহারাজকে দেখিয়ে বলাবলি করছে, ‘আরে দেখ, ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ যাতে হেঁ।’ আমি তাদের কথোপকথন শুনবার জন্য আস্তে আস্তে চলেছি। হঠাৎ হরি মহারাজ আমাকে জোরে ডাক দিয়ে বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে বেড়াতে এসেছ, না ঐসব আজেবাজে কথা শুনতে এসেছ?’
“তারপর মহারাজের সঙ্গে বেড়িয়ে অম্বিকাধামে ফিরে এসে আমি তাঁকে সাষ্টাঙ্গ হয়ে প্রণাম করলুম। হরি মহারাজ হেসে বললেন, ‘কিরে আজ যে তোর ভক্তি বেড়ে গেল!’ তখন তিনি আমাকে কাছে টেনে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন এবং বললেন, ‘দেখ, তোরা যেভাবে ব্রহ্মজ্ঞ ভাবিস, আমি সেভাবে ব্রহ্মজ্ঞ নই। ঠাকুর আমার দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও অদ্বৈত। ঠাকুরই আমার সব।’”৮৩
ভক্তশ্রেষ্ঠ মহাবীর হনুমানের মতোই উপরি-উক্ত মন্তব্যের মাধ্যমে স্বামী তুরীয়ানন্দজী সম্ভবত বলতে চেয়েছিলেন—তিনি যখন নিজেকে দেহ বলে ভাবেন তখন ঠাকুরকে প্রভু এবং তিনি তাঁর ভৃত্য (‘দেহবুদ্ধ্যা তু দাসোঽহং’), যখন নিজেকে জীব তথা দেহধারী আত্মা হিসাবে ভাবেন তখন তিনি নিজেকে ঠাকুরের অংশ (‘জীববুদ্ধ্যা ত্বদংশকঃ’), আর যখন নিজেকে শুদ্ধ আত্মা বলে ভাবেন তখন তিনি নিজেকে ঠাকুরের সঙ্গে অভিন্ন ভাবেন (‘ত্বমেবাহম্’)। এটাই রামকৃষ্ণ–চেতনা অনুশীলনের অন্যতম লক্ষ্য।
রামকৃষ্ণময়তার নিদর্শন
স্বামীজী ছিলেন রামকৃষ্ণ–চেতনায় অধিষ্ঠিত থাকার বিশিষ্ট উদাহরণ। স্বামীজী শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে একদিন বলেন : “তুই তো আমার বক্তৃতা পড়েছিস। কই, কোথায় ঠাকুরের নাম করেছি? খাঁটি উপনিষদের ধর্মই তো জগতে বলে বেড়িয়েছি।” শিষ্য উত্তর দেন : “তা বটে। কিন্তু আপনার সঙ্গে পরিচিত হইয়া দেখিতেছি, আপনার রামকৃষ্ণগত প্রাণ।”৮৪ ঠাকুরের অন্তরঙ্গ ত্যাগী ও গৃহী শিষ্যশিষ্যারাও সকলে ছিলেন ‘রামকৃষ্ণগত প্রাণ’। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম গৃহিভক্ত নবগোপাল ঘোষের স্ত্রী নিস্তারিণী দেবীকে তাঁর ছেলেরা যখন অভিমান করে বলেছিল : “মা, তুমি তো খুব ঠাকুর ঠাকুর করছ। এখন তোমার ঠাকুর আমাদের কী দৈন্যদশাতেই ফেলেছে। ঢের হয়েছে, আর ঠাকুর ঠাকুর করো না।” তাতে নিস্তারিণী দেবী বলে ওঠেন : “বলিস কিরে? আমি যে তাঁকে ভালবেসেছি! আমি যে তাঁকে একবার প্রাণ দিয়েছি রে! তোরা আবার এসব কি বলিস রে?”৮৫
তবে রামকৃষ্ণ-চেতনার সর্বোত্তম অভিব্যক্তি ঘটেছিল শ্রীশ্রীমায়ের জীবনে। তাঁর সম্পর্কে স্বামী অভেদানন্দজী ‘প্রকৃতিং পরমামভয়াং বরদাং’—এই যে অপূর্ব স্তোত্রটি রচনা করেছিলেন, তাতে তিনি লিখেছেন : “রামকৃষ্ণ-গতপ্রাণাং তন্নাম-শ্রবণপ্রিয়াম্/ তদ্ভাবরঞ্জিতাকারাং প্রণমামি মুহুর্মুহুঃ।।” অর্থাৎ, যাঁর চিত্ত শ্রীরামকৃষ্ণে সম্পূর্ণ সমাহিত, শ্রীরামকৃষ্ণ নামশ্রবণ যাঁর একান্ত প্রিয় এবং শ্রীরামকৃষ্ণ-ভাবে যিনি রঞ্জিতা—সেই তাঁকে পুনঃপুন প্রণাম করি। সীতা যেমন ছিলেন রামময়জীবিতা, তেমনি মাও ছিলেন রামকৃষ্ণময়জীবিতা। ভাগনে হৃদয় কৌতুকপরবশ হয়ে একদিন দক্ষিণেশ্বরে শ্রীশ্রীমাকে বলেন : “মামি, তুমি মামাকে (ঠাকুরকে) বাবা বলে ডাক না?” কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে মা উত্তর দিলেন : “উনি বাবা কি বলছ? মাতা, পিতা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন—সবই উনি।”৮৬
শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন
মানুষ স্বভাবতই তার প্রিয়জনের দর্শনের আকাঙ্ক্ষা করে। আর সেই প্রিয়জন যদি তার একান্ত ভালবাসার হয়, তাহলে সে-আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে সুতীব্র এবং তা পূরণের জন্য সে তার সর্বস্ব ত্যাগ করতেও প্রস্তুত হয়। জাগতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেমন তা সত্য, ধর্মজগতে ভক্ত–ভগবান সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তা সত্য। রাধাকৃষ্ণের প্রেম এরই চরম নিদর্শন। ভক্ত যেমন ভগবানকে চায়, ভগবানও তেমনি ভক্তকে চান। কোনো কোনো সাধকের জীবন-ইতিহাসে আমরা দেখি যে, তাঁদের ইষ্টদেবতা বা দেবী সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে তাঁদের দর্শনদানে কৃতার্থ করেছেন। যেমন রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত প্রমুখ। এখন প্রশ্ন হলো—ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণও কি অনুরূপভাবে তাঁর স্থূলদেহ পরিত্যাগের পর তাঁর ভক্তদের দেখা দেন?
বেলুড় মঠের নিয়মাবলিতে স্বামীজী বলেছেন : “শ্রীভগবান্ এখনও রামকৃষ্ণ শরীর ত্যাগ করেন নাই। কেহ কেহ তাঁহাকে এখনও সেই শরীরে দেখিয়া থাকেন ও উপদেশ পাইয়া থাকেন এবং সকলেই ইচ্ছা করিলে দেখিতে পাইতে পারেন।” এই ‘কেহ কেহ’র মধ্যে যে স্বামীজী স্বয়ং ছিলেন তা বলা বাহুল্য। যাই হোক, রামকৃষ্ণ–বিবেকানন্দ সাহিত্যের পাঠক মাত্রেরই জানা, শ্রীরামকৃষ্ণের পূর্বোক্তরূপে দর্শনদানের উদাহরণ ভূরি ভূরি। কাশীপুরের বাগানবাড়িতে ঠাকুরের শরীর যাওয়ার পরই মা যখন সধবার চিহ্নস্বরূপ হাতের নোয়া খুলতে যাচ্ছিলেন তখন ঠাকুর আবির্ভূত হয়ে তাঁর হাত-দুটো ধরে বলেন : “আমি কি কোথাও গেছি গা? এই যেমন এঘর থেকে ওঘর!”৮৭ এরপরও আরো কতবার যে মাকে ঠাকুর দেখা দিয়েছেন বা বলা উচিত তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সবসময় ফিরেছেন, তার কিছু উদাহরণ আমরা মায়ের বিভিন্ন কথাতে পাই।
শ্রীরামকৃষ্ণ অদৃশ্যভাবে স্বামীজী, স্বামী ব্রহ্মানন্দজী প্রমুখ তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্তদের সঙ্গে সঙ্গে ফিরতেন। কখনো স্বপ্নে, কখনো স্থূলরূপে আবির্ভূত হতেন ও দর্শন দিয়ে তাঁদের তীব্র বিরহ–বেদনা প্রশমিত করতেন। কখনো বা উপদেশ–নির্দেশ দিয়ে সঠিক পথে চালিত করতেন, আবার ভাবী বিপদ সম্বন্ধে অবহিত করতেন বা বিপদ থেকে রক্ষা করতেন। মহাপুরুষ মহারাজ একবার বেলুড় মঠে ঘরের মধ্যে স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপ করছিলেন, যেখানে আর কেউ ছিলেন না। একজন ব্রহ্মচারী প্রসাদি ফলমিষ্টি নিয়ে সেই ঘরে ঢুকে শুনতে পেলেন, মহাপুরুষ মহারাজ বলছেন : “রাজা, ঠাকুরকে আমি এখনো দেখতে পাই, তাঁকে যদি দেখতে না পেতাম তাহলে আমার পক্ষে জীবনধারণ কষ্টকর হতো!”৮৮
শুধু অন্তরঙ্গদের নয়, আপাতদৃষ্টিতে তাঁর অপরিচিতদের দর্শনদানের কথাও আমরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারি। যেমন একজন রামায়েত সাধুকে ঠাকুরের দর্শনদানের কথা রামলালদা বর্ণনা করেছেন : “অযোধ্যায় একজন যুবক রামাৎ সাধু বুঝতে পারলেন যে, ভগবান আবার ধরাধামে (পূর্বাঞ্চলে) অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি তাঁকে দেখবার জন্য অযোধ্যা হতে পদব্রজে রওনা হলেন। আসতে আসতে বাংলাদেশে এসে শুনলেন যে, কলকাতার নিকটে রামকৃষ্ণ পরমহংস নামে একজন বড় সাধু আছেন। সন্ধান করে তিনি দক্ষিণেশ্বরে এসে উপস্থিত হলেন। এসেই জিজ্ঞেস কচ্ছেন, তিনি (রামকৃষ্ণ পরমহংস) কোথায়? কালীবাড়ির লোক তাঁকে বললে যে, এই কয়েক দিন হলো তিনি শরীর ত্যাগ করেছেন। এই কথা শুনে সাধুটি ‘হাম এতনা তকলিব করকে অযোধ্যাসে উন্কো ওয়াস্তে পয়দল আঁতে হে আউর ও শরীর ছোড় দিয়া?’ এই বলে খুব কাঁদতে লাগলেন। ওঁকে কালীবাড়ির সদাব্রত হতে ভিক্ষা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলে, কিন্তু তিনি কিছু না খেয়ে ২/৩ দিন পঞ্চবটীতে পড়ে রইলেন। এ সময় একদিন রাত্রে তিনি দেখেন—নহবতের পাশে বকুলতলার ঘাট দিয়ে ঠাকুর গঙ্গা থেকে উলঙ্গ অবস্থায় উঠলেন; উঠে ওঁকে বললেন, ‘তুই এ কদিন খাস নি, এই পায়েস এনেছি, খা।’ এই বলে ওঁকে খাওয়ালেন এবং তারপর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। পরদিন সকালে আমি পঞ্চবটীতে গিয়ে দেখি সাধুটির খুব আনন্দ। জিজ্ঞেস করলুম, ‘তুমি এতদিন বিমর্ষ ছিলে, হঠাৎ তোমার এত আনন্দ দেখছি কেন?’ সাধুটি তখন সমস্ত বৃত্তান্ত বললেন এবং ঠাকুর যে মাটির সরাতে করে ওঁকে পায়েস খাইয়েছিলেন সে সরাটিও দেখালেন।”৮৯
স্বামীজীর আহ্বানে স্বামী সারদানন্দজী পাশ্চাত্যে বেদান্তপ্রচারের জন্য গেলে মন্টক্লেয়ার-বাসিনী মিসেস এফ. হুইলারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। মিসেস হুইলার ছিলেন ভক্তিমতী, স্নেহপ্রবণা এবং বুদ্ধিমতী। স্বামী সারদানন্দজীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিশ বছর পূর্বে স্বপ্নে এক সাধুকে তিনি দেখেছিলেন। সেই সাধুটি তখন তাঁকে বলেছিলেন : “আমার ছেলেরা সব আসবে, তুমি তাদের যত্ন কোরো।” স্বামী সারদানন্দজীর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর একদিন তাঁর গীতার ভিতর ঠাকুরের ছবি দেখে তিনি বলে ওঠেন : “এঁকে তো আমি বহু পূর্বে দেখেছি।” তখন তিনি স্বপ্নের সব কথা প্রকাশ করেন।৯০
রামকৃষ্ণ-চেতনা যখন প্রগাঢ় হয় এবং শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি জীবনের সমস্ত ভালবাসা কেন্দ্রিত হতে থাকে, তখন শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন-আকাঙ্ক্ষা ভক্তদের মনে তীব্র আকার ধারণা করে। তবে সেই দর্শনলাভ শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপাসাপেক্ষ—কোনো শর্তসাপেক্ষ নয়। মায়ের দীক্ষিতসন্তান ও তাঁর এককালের সেবক স্বামী শান্তানন্দের স্মৃতিকথা এপ্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ১৩১৬ বঙ্গাব্দে তিনি কাশী থেকে কলকাতায় উদ্বোধনে মায়ের বাড়িতে আসেন। একদিন মাকে নিবেদন করেন : “মা, আমি যখন ৺কাশী থেকে এখানে চলে আসি, ব্রহ্মবাদিন্ (পূর্বাশ্রমের নাম বঙ্কুবাবু) তখন আমাকে আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিলেন, কতদিনে তাঁর উপর আপনার কৃপা হবে। মা এতক্ষণ স্বচ্ছন্দে কথাবার্তা কহিতেছিলেন, কিন্তু এই কথা শুনিবামাত্র মা খুব গম্ভীর হইয়া গেলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলেন, ‘দেখ, ঋষিরা ঊর্ধ্বদিকে পা আর অধোদিকে মাথা করে হাজার হাজার বছর ধরে তপস্যা করতেন, তাতে কারও ওপর কখনও তাঁর কৃপা হতো, আবার কখনও হতো না। সে যে একটু কঠোর করছে বলেই তাঁর কৃপা হবে এর কোন মানে নেই। কঠোরতা করে কেউ তাঁকে পায় না; তাঁর দয়াতেই তাঁকে পাওয়া যায়। তুমি এই কথাটা তাঁকে লিখে দাও।’”৯১
সুতরাং রামকৃষ্ণ–চেতনা প্রবুদ্ধ করা এবং তাঁর দর্শনের জন্য ব্যাকুলতার সাথে সাথে শবরীর মতো প্রতীক্ষা করে থাকা ছাড়া ঠাকুরের দর্শনলাভের আর অন্য কোনো পথ নেই।
শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন প্রসঙ্গে আরো বলা প্রয়োজন যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সে-দর্শন মনের নিছক কল্পনাও হতে পারে। তাই সেই দর্শন যথার্থ কি না তার মানদণ্ড হলো—এই দর্শন ভক্তের চরিত্রে ও আধ্যাত্মিক জীবনে স্থায়ী প্রভাব ফেলবে এবং তার স্মৃতিমাত্রই তার মনে গভীর আনন্দের ভাব জাগবে। এপ্রসঙ্গে স্বামীজীর বক্তব্য ছিল—এক বা দুবার অলৌকিক দর্শনের থেকে অনেক বেশি জরুরি হলো—‘কে কতটা সংযমী, ধ্যানপরায়ণ, ত্যাগী ও বৈরাগ্যবান’।৯২ [ক্রমশ]
তথ্যসূত্র
৬৮ দ্রঃ The Complete Works of Swami Vivekananda, Advaita Ashrama, Kolkata, 2021, vol. 1, p. 101
৬৯ কথামৃত, পৃ: ৪৪৩
৭০ সঙ্গীত-সংগ্রহ, পৃ: ১৩৯
৭১ স্বামী অপূর্বানন্দ (সংকলক), শিবানন্দ-স্মৃতিসংগ্রহ, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০০৫, অখণ্ড, পৃ: ৬৯৪-৯৫
৭২ ঐ, পৃ: ৬৯৪-৯৫
৭৩ শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ, ৪।৪
৭৪ স্বামী গম্ভীরানন্দ, শ্রীমা সারদা দেবী, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৯, পৃ: ২৮১
৭৫ মাতৃদর্শন, পৃ: ১২৩
৭৬ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৪।২৪
৭৭ দ্রঃ চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রশেখর, শ্রীশ্রীলাটু মহারাজের স্মৃতি-কথা, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৮৫, পৃ: ১৮০
৭৮ স্বামী চেতনানন্দ (সংকলক), স্বামী বিজ্ঞানানন্দের স্মৃতিকথা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৪, পৃ: ৩০৩
৭৯ “যখনই যা-কিছু আহার করবে, তা ভগবানকে নিবেদন করে প্রসাদস্বরূপ গ্রহণ করবে। তাহলে রক্ত শুদ্ধ হবে, রক্ত শুদ্ধ হলে মনও শুদ্ধ হবে।” (শ্রীশ্রীমায়ের কথা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১১, পৃ: ২৯-৩০) ‘আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ।’ (ছান্দোগ্যোপনিষদ, ৭।২৬।২)
৮০ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, গীত বিতান, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা, ১৪১২, অখণ্ড, পৃ: ৬৪-৬৫
৮১ কথামৃত, ১৯৯৭, অখণ্ড, পৃ: ১১০, ৩৪১
৮২ দ্রঃ স্বামী নিত্যাত্মানন্দ, শ্রীম-দর্শন, শ্রীম ট্রাস্ট, শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীম প্রকাশন ট্রাস্ট, চণ্ডীগড়, ২০০৯, ৯ম ভাগ, পৃ: ১৩৬-৩৭
৮৩ স্বামী চেতনানন্দ (সংকলক), স্বামী তুরীয়ানন্দের স্মৃতিকথা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০০৬, পৃ: ৩৪৫
৮৪ চক্রবর্তী, শরচ্চন্দ্র, স্বামি-শিষ্য-সংবাদ, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১২, পৃ: ২৮-২৯
৮৫ স্বামী অপূর্বানন্দ, দেবলোকে, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, কলকাতা, ১৯৯২, পৃ: ২৪৪
৮৬ শ্রীমা সারদা দেবী, ২০১৪, পৃ: ৩৪৩
৮৭ ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য, শ্রীশ্রীসারদা দেবী, ক্যালকাটা বুক হাউস (প্রাঃ) লিঃ, কলকাতা, ১৪১৫, পৃ: ৫৮
৮৮ শিবানন্দ-স্মৃতিসংগ্রহ, পৃ: ২১
৮৯ স্বামী চেতনানন্দ (সংকলক), শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৫, পৃ: ৩৯
৯০ স্বামী তুরীয়ানন্দের স্মৃতিকথা, পৃ: ২২৬
৯১ মাতৃদর্শন, ১৯৯০, পৃ: ৩৩
৯২ দ্রঃ স্বামী চেতনানন্দ (সংকলক ও সম্পাদক), স্বামী সুবোধানন্দের স্মৃতিকথা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০০৫, পৃ: ১৫৫