মানুষটি কেমন ছিলেন তা চারটি ক্ষুদ্র পঙ্ক্তিতে বেঁধে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর—
“কালীমোহনের অশেষ গুণ!
যে তারে জানে—সে-ই জানে
দীনদুখে হৃদয়ে জ্বলে আগুন
অবিচার সহে না প্রাণে॥”১
অবিভক্ত বাংলায় ত্রিপুরা জেলার চাঁদপুর শহরের কাছে বাজাপ্তি গ্রামে জন্ম হয়েছিল এই ক্ষণজন্মা পুরুষটির। ১৮৮২ (মতান্তরে ১৮৮৪) সালে তাঁর জন্ম। গরিব ঘরে জন্ম, দারিদ্র ছিল চিরসঙ্গী, স্বাস্থ্যও ছিল খারাপ। কিন্তু অদম্য মনোবল ও মেধা ছিল কালীমোহনের। ছিল দেশকে জানার ও সেবাব্রতের অদম্য নেশা। ১৯০৩—০৫-এর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। তখন তিনি কলেজের ছাত্র, পড়াশোনা ছেড়ে অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্যরূপে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন ও বিদেশি পণ্যবর্জন আন্দোলনে মেতে উঠলেন কালীমোহন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন আর দেখলেন পল্লিবাসীদের দুরবস্থা। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলেন বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামে। পরিচিত হলেন সেখানকার আরেক মেধাবী যুবক ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে। স্বল্প পরিচয় থেকে নিবিড় বন্ধুতায় পৌঁছাতে বিশেষ সময় লাগেনি। দুজনেই দেশের কথা ভাবেন, সাহিত্যরসিক। বিশেষ করে রবীন্দ্রসাহিত্যে উৎসাহী। ১৯০৪ সালে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ স্বল্প সময়ের ব্যবধানে দু-জায়গায় দুবার পাঠ করে শুনিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘স্বদেশী সমাজ’। কালীমোহনের পক্ষে তখন কলকাতায় আসা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এই প্রবন্ধটি তিনি তন্ন-তন্ন করে পড়েছিলেন ‘প্রবাসী’ পত্রিকার পৃষ্ঠায়। রাজনীতি-সচেতন কালীমোহন যেন কাজের দিশা খুঁজে পেলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের মূল আহ্বান ছিল—দেশের কাজ করা মানে দেশকে গঠন করা, আত্মশক্তির মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হওয়া। আমাদের রাজনীতি কেবলই বিরোধাত্মক, ‘অ্যাজিটেশন’মুখী; স্বদেশকে গঠন করতে হবে সদর্থক গঠনের কাজ করে। গ্রামগঠন, পল্লিসংস্কার, সমবায় আন্দোলন গড়ে তোলা—এইসব হলো মূল কাজ। সর্বপ্রথম কাজ হলো দেশকে চেনা—দেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি, পুরাতত্ত্ব থেকে শুরু করে স্বদেশের দারিদ্র-পীড়িত অর্থনীতি ও গ্রামীণ জীবনযাপনের খুঁটিনাটিকে জানা। ঐ জানা না হলে কাজের দিশা পাওয়া যাবে না। এইসব কথাবার্তা কালীমোহনকে আকৃষ্ট করল। এর বছর দুয়েক বাদেই ১৯০৬ সালে বরিশালে প্রাদেশিক সম্মিলন উপলক্ষে যে-সাহিত্য সম্মিলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কালীমোহন ঘোষ কবির সঙ্গে দেখা করেন, জানালেন তাঁর কাজ করার অভীপ্সার কথা। এর বছর দুয়েক বাদে ১৯০৮ সালে প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেন রবীন্দ্রনাথ। পাবনা কংগ্রেসের সভাপতি-ভাষণের বেশির ভাগ অংশটাই ছিল গ্রামগঠনের প্রস্তাব। ‘স্বদেশী সমাজ’-এর ভাষণে যা ছিল দার্শনিক উপস্থাপনা, এই কংগ্রেসের ভাষণে তার রূপরেখা ছকে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। কালীমোহন আরো আকৃষ্ট হয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করলেন। কবি তখন শিলাইদহের জমিদারি এস্টেটে পল্লিপুনর্গঠনের কাজ শুরু করে দিয়েছেন, কালীমোহনকে তিনি আহ্বান করলেন এই কাজে যোগ দেওয়ার জন্য। কালীমোহন চলে গেলেন শিলাইদহে, সঙ্গে আরো চারজন যুবক—ভূপেশচন্দ্র রায়, অনঙ্গমোহন চক্রবর্তী, প্যারীমোহন সেন ও অক্ষয়চন্দ্র সেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে কাজ শুরু হলো। কিন্তু দুর্বল স্বাস্থ্যের কালীমোহন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কাশরোগে আক্রান্ত হলেন তিনি। কিন্তু ঐ স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি কবির বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছেন, হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথের বিশ্বস্ত সহচর। এই ঘটনার অনেকদিন পর ১৯৩৯ সালে শ্রীনিকেতনের এক কর্মিসভায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন : “তখনকার দিনে এই কাজে আমার একমাত্র সহায় ছিলেন কালীমোহন। তাঁর রোজ দু’বেলা জ্বর আসত। ঔষধের বাক্স খুলে আমি নিজেই তাঁর চিকিৎসা করতুম। মনে করতুম তাঁকে বাঁচাতে পারব না।”২
বেঁচে অবশ্য ছিলেন কালীমোহন রবীন্দ্রপরিকর হয়ে ১৯৪০ সালের ১০ মে পর্যন্ত। হঠাৎই তাঁর মৃত্যু ঘটে, তখনকার ভাষায়—সন্ন্যাসরোগে। কিন্তু ব্যাধিতে আক্রান্ত কালীমোহনকে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন তাঁর শান্তিনিকেতন আশ্রমে। সেখানে শিশুবিভাগের দেখাশোনা ও শিক্ষকতার কাজে লিপ্ত হলেন কালীমোহন। মাঝে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য কবি তাঁকে গিরিডিতে পাঠিয়েছিলেন। গিরিডিতে গিয়ে তাঁর স্বাস্থ্যের বিস্ময়কর উন্নতি ঘটেছিল। ১৯০৮ সালে নভেম্বর মাসে (বাংলা ২৩ কার্তিক ১৩১৫) রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে কালীমোহনকে লিখছেন : “তুমি গিরিডিতে গিয়া ভাল আছ শুনিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম। গিরিডিতে আমি যখন ছিলাম আমারও স্বাস্থ্যের উন্নতি হইয়াছিল। ওখানে তুমি যথাসম্ভব সমস্ত দিন বনের মধ্যে খোলা হাওয়ায় যাপন করিবার চেষ্টা করিবে।”৩ পরের মাসেই ২ অগ্রহায়ণ আবার লিখছেন : “…তোমার চিকিৎসা কিরূপ চলিতেছে? ক্রিয়োজোট ঔষধটা ঘন ঘন না খাওয়াই কর্তব্য। এ ঔষধের কুফল আছে। যদি খোলা হাওয়া সেবন করিয়া তোমার কাশিটা ভাল থাকে তবে ঔষধটা পারতপক্ষে ব্যবহার করিয়ো না। সমস্তদিন যতক্ষণ পার শালবনের মধ্যে খোলা আকাশে বসিয়া কাটাইয়ো এবং পেটের গোলমাল না হইলে দুধ মাখন প্রভৃতি পুষ্টিকারক পদার্থ খাইয়ো।”৪
ব্রহ্মচর্যাশ্রমে কালীমোহন শিশুদের শিক্ষা ও ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েই থেমে ছিলেন না, তাঁর রক্তে ছিল গ্রামসেবা। সময়-সুযোগ পেলেই চলে যেতেন শান্তিনিকেতন-সন্নিহিত গ্রামগুলিতে—সাঁওতালপল্লিতে। সঙ্গে নিয়ে যেতেন বিদ্যালয়ের বয়স্ক ছাত্রদের। বছর পাঁচেক বাদে ১৯১৩ সালে কালীমোহনের গ্রামসংগঠনের কাজে সঙ্গী হলেন উইলিয়াম পিয়ার্সন সাহেবও।
বঙ্গদেশ তথা ভারতবর্ষ তো কৃষিপ্রধান ও কৃষিজীবীদের দেশ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে মার্কিন দেশে পাঠিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যা ও গোপালন শিক্ষা অর্জনের জন্য। কিছু পরে জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কেও একই উদ্দেশ্যে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল নিজের জমিদারি এস্টেটে কৃষি-উন্নয়ন ও গ্রামোন্নয়নের জন্য এঁদের কাজে লাগাবেন। শিলাইদহ, পতিসর ইত্যাদি অঞ্চলে কিছু কিছু কাজ হয়েছিল; অবশ্য কবির মতে তা আশানুরূপ হয়নি। ১৯২২ সালে সুরুলে স্থাপন করলেন Institute of Rural Reconstruction, লেনার্দ এল্মহার্স্ট যার মূল পুরোহিত। কালীমোহন ঘোষ হলেন তাঁর প্রধান সেনাপতি। কিন্তু এর এগারো বছর আগে ১৯১১ সালে কালীমোহন উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অদম্য উৎসাহ ছিল এর পিছনে। কিন্তু আর্থিক সংগতির জন্য কালীমোহনকে আরো কয়েকজন বন্ধুর সাহায্য নিতে হয়েছিল। সে-সাহায্য বেশিদিন না পাওয়ার কারণে কালীমোহনকে শিক্ষা সম্পূর্ণ না করেই ফিরে আসতে হয়েছিল। কিন্তু ঐ অল্পদিনের মধ্যেই তিনি লন্ডনের সুধীসমাজে অন্তরঙ্গ সাথী হয়ে উঠেছিলেন। ইংরেজ কবি ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, শিল্পী রোটেনস্টাইন কালীমোহনের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য এরও কারণ রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের মধ্যস্থতাতেই কালীমোহন এঁদের সাহচর্য পেয়েছিলেন। রোটেনস্টাইনের ছবির মডেলও হয়ে উঠেছিলেন কালীমোহন।
রবীন্দ্রনাথের ভাবাদর্শে গঠিত শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২২ সালে। লেনার্দ এল্মহার্স্ট তার প্রধান রূপকার আর দোসর ছিলেন কালীমোহন ঘোষ—একথা একটু আগেই উল্লেখ করেছি়। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ, গৌরগোপাল ঘোষ, নন্দলাল বসুরাও সঙ্গে ছিলেন। সকলেরই যথানির্দিষ্ট ভূমিকা ছিল। কালীমোহন ছিলেন এক অর্থে অগ্রপথিক। কালীমোহনের জ্যেষ্ঠপুত্র শান্তিদেব ঘোষ তাঁর জীবনের ধ্রুবতারা গ্রন্থে পিতৃস্মৃতি বিশ্লেষণ করে লিখেছিলেন : “এলমহার্স্ট্ প্রথমেই পিতৃদেবের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে শ্রীনিকেতনের নিকটবর্তী কয়েকটি গ্রামের মানুষদের সামগ্রিক জীবনের পরিচয় নিলেন। গ্রামবাসী ধনী দরিদ্র সকলের সঙ্গে পিতৃদেবের মাধ্যমে চেষ্টা করলেন তাদের জীবনের সামগ্রিক পরিবেশকে জানতে। তারপর তাঁরা স্থির করলেন গ্রামোন্নয়নের পরিকল্পনাকে দু’ভাগে ভাগ করে তাঁরা কাজে নামবেন। স্থির হল, শ্রীনিকেতনে চলবে শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ লোক মারফৎ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আর্থিক উন্নতির প্রয়োজনীয় নানা দিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ এলমহার্স্টের নেতৃত্বে ও পরিচালনাধীনে। তাকে কার্যকরীভাবে গ্রামের দরিদ্র সমাজে প্রয়োগ করবার দায়িত্ব থাকবে পিতৃদেবের উপরে। কাজে হাত দিয়ে পিতৃদেব স্থির করেছিলেন গ্রামবাসীদের মনকে সমবায়নীতি এবং আত্মবিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সেই পথেই তাঁর কাজ শুরু হল। পল্লী উন্নয়ন বিভাগের কর্মীদের দ্বারা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা করলেন দরিদ্র কৃষিজীবীদের জন্য ঋণদান ব্যাংক, ধর্মগোলা, কৃষি সমবায়, স্বাস্থ্য সমবায়, শিক্ষা সমবায়, শিল্প সমবায়।”৫
কিন্তু এত সব কাজের জন্য চাই প্রচুর জনবল। রবীন্দ্রনাথের নির্দেশে কালীমোহন তৈরি করলেন ব্রতী বালক দল। এই ব্রতী দল গঠনের এক পটভূমি আছে। ১৯২২ সালে শ্রীনিকেতনের কাজ শুরু হওয়ার পর শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক ধীরানন্দ রায় ও বিনায়ক মাসোজিকে জব্বলপুরে পাঠানো হয়েছিল স্কাউট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের স্কাউট দলের নাম দিয়েছিলেন ‘সহায়ক দল’। ১৯২৩ সালে সাতটি স্কাউট দল গঠিত হয়ে যায়। গোড়ার দিকে এই স্কাউট দলের বালক ও যুবকদের লক্ষ্য ছিল নিজেদের শরীরচর্চা ও আত্মচর্চা এবং পারিপার্শ্বিক পল্লিগুলিতে উন্নয়নে শামিল হওয়া। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ সহায়ক দলের নাম পরিবর্তন করে এদের নতুন নামকরণ করলেন। পরিবর্তিত নাম হলো ‘ব্রতী বালক দল’। ব্রতীরা শ্রীনিকেতনের পল্লিসেবা বিভাগের গ্রামোন্নয়নের কাজকে আরো সংগঠিত রূপ দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন গ্রামকর্মীদের সহায় হয়ে উঠল। এই ব্রতী দলগুলি পরবর্তিকালে কেবল সংখ্যায় বাড়েনি, শ্রীনিকেতনের সাহায্য ব্যতিরেকেই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। দীক্ষিত সিংহ তাঁর রবীন্দ্রনাথের পল্লিপুনর্গঠন-প্রয়াস গ্রন্থে এবিষয়ে লিখেছেন : “ব্রতীদলের প্রসারণ যে গ্রামবাংলায় যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল তার আর একটি প্রমাণ ১৯২৪ সালের শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত ব্রতীবালকদের সম্মেলনে সহ-সভাপতির ভাষণে অবিনাশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ব্রতীদের কাজ আলোচনা প্রসঙ্গে যে বীরভূম জেলার সে-সময়ের যত উচ্চ ও মধ্য ইংরেজি স্কুল ছিল তার অর্ধেক শিক্ষকই পল্লিসংগঠনের কাজ শিখেছিলেন। বাকি যেসব স্কুল ছিল তাদের শিক্ষকরাও পল্লিসংগঠনের কাজ শিখে বীরভূমের গ্রামোন্নয়নের কাজকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন। এইভাবে শ্রীনিকেতনের পল্লিসংগঠনের কাজ শ্রীনিকেতনের কাজের এলাকা ছাড়িয়ে দূর দূরান্তে ছড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল।”
শুধু বীরভূম জেলা নয়, একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে—১৯২৪ সালে বাংলার বিভিন্ন জেলায় ব্রতী দলের সভ্যসংখ্যা ৬০৮-এ পৌঁছায়। ১৯২৭-এ তার আরো বিস্তার ঘটে, মোট চল্লিশটি দলের মোট সদস্যসংখ্যা ছিল প্রায় আটশো। এই বিস্তারের পিছনে কালীমোহন ঘোষ ও ধীরানন্দ রায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯২৯ সালের বৈশাখ মাস থেকে ‘ব্রতীবালক’ নামে একটি পত্রিকাও শান্তিনিকেতন থেকে প্রকাশ করা শুরু হয়েছিল, পত্রিকাটি অবশ্য দুবছর পরেই বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ধীরানন্দ রায় ও সতীশচন্দ্র রায়। সতীশচন্দ্র রায়ের অকালমৃত্যুর কারণেই পত্রিকা চালানো সম্ভব হয়নি।
কালীমোহন ঘোষ ও তাঁর সঙ্গীরা গ্রামবাসীদের সমবেত প্রচেষ্টাকে সংহত করে পথ-ঘাট তৈরি, জঙ্গল পরিষ্কার, জলা-ডোবা সংস্কার, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি থেকে শুরু করে গ্রামবাসীদের পারস্পরিক বিবাদ-বিসংবাদ মেটানোর জন্য সালিশি ব্যবস্থা তৈরি করতেন। এতে আদালতে ব্যয়বহুল মামলা-মকদ্দমা এড়ানো যেত। গ্রামের স্বল্পশিক্ষিতদের জন্য ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার, বয়স্ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিও গড়ে তোলা হতো। নানাপ্রকার কারুশিল্প, সূচিশিল্প, খেলা-ধুলোতেও উৎসাহ দেওয়া হতো। আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতির দিকে লক্ষ্য রেখে গ্রামবাসীদের গান-বাজনা, নাটক ইত্যাদি সংগঠিত হতো। ক্রমে তৈরি হয়েছিল ম্যালেরিয়া-নিবারণী সমিতি। যক্ষার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। আর ছিল অস্পৃশ্যতা বর্জনের আন্দোলন। এসব কােজর জন্য প্রয়োজন গ্রামসমীক্ষা, তথ্যসংগ্রহ ইত্যাদি কাজ। কালীমোহন ঘোষ ১৯২৬ সালে বল্লভপুর ও ১৯৩৩ সালে রায়পুর গ্রাম-দুিটর তথ্যসংগ্রহের কাজ করে গুরুত্বপূর্ণ দুটি গ্রন্থ তৈরি করেছিলেন। এর আগে ১৯২৩ সালে কালীমোহন ‘সংহতি’ শীর্ষক পত্রিকায় দুই কিস্তিতে লিখেছিলেন ‘পল্লীসেবা’ নামে এক প্রবন্ধ। বীরভূম জেলার বিভিন্ন গ্রামে হিন্দু, মুসলমান, সাঁওতাল সমাজের সমস্যাবহুল জীবন নিয়ে এমন তথ্যবহুল রচনা সেযুগে বিশেষ পাওয়া যেত না। ঐ ‘পল্লীসেবা’ প্রবন্ধেই লেখক জানিয়েছিলেন : “পল্লীর একটি সমষ্টিগত মনোবৃত্তি আছে। সে নিয়তই কিছু সৃজন করিতেছে, তাহার পশ্চাতে সহস্র বৎসরের ধারাবাহিকতা রহিয়াছে়। ইহার গতি কোন্ দিকে তাহা পর্যালোচনা করিয়া সেবকের জীবনকে তদনুযায়ী গড়িয়া তুলিতে হইবে। নতুবা শহরের বাঁধা মত অর্থাৎ political economy-র বাঁধা বুলিগুলি পল্লীর ঘাড়ে চাপাইয়া শিবের স্থানে বাঁদর গড়িয়া ফেলিবার ভয় রহিয়াছে়।”৬
রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় বারবারই কৌমচেতনার কথা বলতেন (রাবীন্দ্রিক ভাষায় সমাজচেতনা), স্মরণ করিয়ে দিতেন সমাজমনের স্বাভাবিক গতিধারার কথা। সেসব উপেক্ষা করে শহুরে শিক্ষিতরা যখন গ্রামসেবার কাজে যোগ দিতেন, তখন উপকারের পরিবর্তে বিভ্রাট তৈরি হতো বেশি। কারণ, ওপর থেকে নীতিবাক্য চাপিয়ে দিলে গ্রামীণ মানুষের কাছে তা হয়ে উঠত ভয়াবহ, গ্রহণের অযোগ্য। পল্লীপ্রকৃতি ও সমবায়নীতি পুস্তিকা-দুটিতে এবিষয়ে কবির অজস্র সতর্কবাণী আছে। রবীন্দ্র-পরিকর কালীমোহন ঘোষেরা সেসব বিষয়ে অবগত ছিলেন। কাজ করতে গিয়েও বুঝেছিলেন, দুর্বলের মনের খোঁজ না পেলে দুর্বলকে সক্ষম করে তোলা যায় না। দুর্বলের বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য তার বন্ধু হয়ে ওঠা দরকার।
আরো একটা গভীর সত্য বুঝেছিলেন কালীমোহন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিষয়ক সে-চেতনা। রবীন্দ্রনাথ বারবার বলতেন, আমাদের সব সমস্যার মূল হলো দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক জানাচেনার অভাব। এই সমস্যা শহরাঞ্চলে প্রকট। কালীমোহন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন এইভাবে—“বীরভূম জেলার একটি মুসলমান পল্লীতে রাধু গোপ নামক একজন হিন্দুর লিখিত মহরম সম্বন্ধে একটি কাব্য পাওয়া গিয়াছে। তাহার উপরে লিখা ‘শ্রীহরি সহায়’, ভিতরে মহম্মদের গুণগান।” কালীমোহনের মন্তব্য—“এই কাব্যের ভিতরে দেখিতে পাই যে, কবি একদিকে মুসলমানদিগের মহরমের ভিতরকার ভাবকে পরিপূর্ণ আবেগের সহিত প্রকাশ করিয়াছেন। অপরদিকে তারই মধ্য দিয়া কবি অগোচরে অলক্ষ্যে তাহার উপর হিন্দুর মনের ছাপ রাখিয়া দিয়াছেন। পল্লীসাহিত্যের মধ্য দিয়া এই যে ঐক্যের সূত্র হইতেছে তাহার মূল্য খুব বেশি।”৭
অতিশয় মূল্যবান কালীমোহন ঘোষের এই প্রতীতি। বাংলার গ্রামগুলিতে ঘুরে বেড়ালে এখনো চোখে পড়ে গ্রামীণ মানুষের গৃহস্থালির সৌন্দর্য, বিশেষত দারিদ্র-লাঞ্ছিত আদিবাসী গ্রামগুলিতেও মাটির বাড়ির গায়ে আলপনা, পরিষ্কার নিকানো উঠান এখনো বিদ্যমান। কালীমোহনের রচনায় একথার সমর্থন আছে। তিনি লিখেছেন : “এ দেশের কামার কুমার ছুতার সকলের মধ্যেই দেখি কারিগর শুধু লৌকিক প্রয়োজনীয়তার দিক দিয়া বিচার করিয়া কোনো জিনিস গড়ে না। সে তার চিত্তের একটি ছাপ তার মধ্যে রাখিতে চেষ্টা করে। এই জন্য অতি সাধারণ সস্তা জিনিসের মধ্যেও এই ভারতীয় শিল্পীদের চারুশিল্পের যত প্রকার বৈচিত্র্য দেখা যায়, জগতের অন্য কোথাও তাহা দেখা যায় না। বিলাতি ধরনের খাড়া গ্লাস বা পেয়ালার আমদানি হওয়ার পূর্বে এ দেশে জল খাওয়ার গ্লাসের যে কত বিচিত্র নক্সা ছিল, তাহা এই বীরভূমের কোনো পুরাতন গৃহস্থের গৃহে গেলে দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয়।”৮
‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বেশ বিস্তৃত আকারে গ্রামীণ মেলার গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছিলেন। লিখেছিলেন, মেলা মানুষের ভাববিনিময়ের কেন্দ্র, কেবল সওদাগিরির স্থান নয়। মুখোমুখি সম্পর্কের, প্রীতিস্থাপনের ক্ষেত্র হলো মেলা। মেলায় সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটে, কৌমচেতনা সংহতি লাভ করে। অতএব ভারতবর্ষে মেলার বিকল্প কিছু হতে পারে না। এমনকী মনীষীদের স্মৃতিস্তম্ভ বা প্রস্তরমূর্তি তৈরির চেয়ে জয়দেবের নামাঙ্কিত অথবা কৃত্তিবাসী মেলা মনীষী-বন্দনার অনন্য উপায়। এতে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে তাঁদের গুরুত্ব স্থায়ী আসন লাভ করে।
কালীমোহনের রচনায় মেলার গুরুত্বের এই ছবি চমৎকার ফুটে উঠেছে—“…আমরা কেন্দুবিল্বে জয়দেবের মেলা দেিখতে যাই। সেখানে যে শিক্ষা লাভ করিয়াছি, তাহার প্রভাব আজীবন আমাদের চিত্তে আধিপত্য বিস্তার করিয়া রহিবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই বিরাট মেলা চলিয়া আসিয়াছে। লক্ষ লোক কত দূর দূরান্তর হইতে ভক্তির আবেগে ব্যাকুল হইয়া এইখানে আসিয়া উপস্থিত হয়। কোনো আশ্রয় নাই, কোনো ব্যবস্থা নাই—নদীতীরের উন্মুক্ত প্রান্তরে পৌষ-সংক্রান্তির প্রবল শীতে প্রাণের প্রাচুর্যে প্রকৃতির বিরুদ্ধতাকে উপেক্ষা করিয়া ভক্তগণ গানের ফোয়ারা ছুটাইয়াছে; শত শত বাউল একতারা ঊর্ধ্বে তুলিয়া নৃত্যের ছন্দে, সুরের ঝঙ্কারে, ভাবের উন্মাদনায় সমস্ত প্রান্তরকে মাতাইয়া তুলিয়াছে। সেখানে কোনো কর্তা নাই, কোনো কমিটি নাই, কোনো সেক্রেটারির উপদ্রব নাই। প্রত্যেকেই স্বাধীন। এই মেলা প্রত্যেকেরই আপনার জিনিস, হৃদয়ের জিনিস।… ফরাসীদেশীয় মনীষী সিলভাঁ লেভি মহোদয়ও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘কি সৌভাগ্য যে আমি এখানে আসিতে পারিয়াছি়। এখানে আসিয়া বাঙালি জাতির যথার্থ পরিচয় পাইলাম। আমি ফিরিয়া গিয়া আচার্য রবীন্দ্রনাথকে বলিব যে, এই জাতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কোনো ভয়ের কারণ নাই। যে জাতির অশিক্ষিত জনসাধারণের হৃদয়ের মধ্যে এত বড়ো পবিত্র রসবোধ ও স্পন্দনশক্তি রহিয়াছে, সে জাতি অমর।’”৯
মহাত্মা গান্ধি শিল্পসমৃদ্ধ (অর্থাৎ ‘ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজ্ড’) আধুনিক সভ্যতার বিরোধী ছিলেন। রেলগাড়ি, ডাক্তার, উকিল-আদালতকে মনে করতেন মানুষের শত্রু। হিন্দস্বরাজ পুস্তিকায় আছে সেসব কথা। ব্যয়সাপেক্ষ আধুনিক আদালত ব্যবস্থাকে রবীন্দ্রনাথও পছন্দ করতেন না। তার চেয়ে গ্রামীণ পঞ্চায়েত ও সালিশি ব্যবস্থা গরিব মানুষের বন্ধু—একথা গান্ধি-রবীন্দ্রনাথ দুজনেই বলেছিলেন। ‘পল্লীসেবা’ প্রবন্ধে কালীমোহন লিখেছেন, তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছে এক মামলাপ্রিয় মুসলমান গ্রামের ছবি দেখে যে, গ্রামের এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ নষ্ট হয় শুধু মামলা-মকদ্দমার জন্য। তিনি গ্রামের মানুষদের বোঝালেন, বছরে মামলা করে যে-টাকা ব্যয় করা হয় তার এক-দশমাংশ ব্যয়ের দ্বারা পাঁচ বছরের মধ্যে ঐ গ্রামের স্বাস্থ্যোন্নতি ও শিক্ষাবিস্তার সম্ভব। গ্রামের মানুষেরা সালিশি ব্যবস্থায় সম্মত হলেন। কিন্তু বহুিদন ধরে উকিল ও তাদের দালালদের কাছে মক্স করে ঐ গ্রামীণ মানুষেরা এমন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন এবং তাঁদের স্বভাব এমন বিকৃত হয়ে গেছে যে, সত্য নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে।১০ কালীমোহন ও তাঁর সঙ্গীরা তাতে অবশ্য পিছিয়ে আসেননি। ব্যবস্থা পরিবর্তনের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।
বীরভূম জেলার হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে এক-তৃতীয়াংশ অধিবাসী অন্ত্যজ। অর্থাৎ হাড়ি, বাউরি, বাগদি, মাল সম্প্রদায়ের মানুষ। সম্পন্ন উচ্চবর্ণের মানুষদের চোখে তারা ‘ছোটলোক’। এছাড়া সাঁওতালরা তো আছেই। বহু শতাব্দীর জাত্যভিমানের িনষ্পেশনে এই অন্ত্যজ মানুষগুলি একেবারে মনুষ্যত্বহীন হয়ে পড়েছে। সস্তায় মজুরি করে অথবা মনিবের জমি চাষ করে তাদের অন্নবস্ত্র জোটে। সম্মান, মর্যাদা, শিক্ষা কিছুই তাদের নেই। কালীমোহন জানাচ্ছেন—অথচ এই হাড়ি-বাউরিরাই একসময় অসাধারণ বাহুবলে বঙ্গের সীমান্তদেশ রক্ষা করে স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। এদের পূর্বপুরুষেরাই বিষ্ণুপুর রাজ্য স্থাপন করেছিল। বীরভূম ও বাঁকুড়া এই রাজ্যেরই অন্তর্গত ছিল। ‘ধর্মমঙ্গল’-এর কাহিনিতে বর্ণিত ইছাই ঘোষ ও লাউসেনের লড়াই হয়েছিল কেঁদুলির অপর পারে অজয় নদের অনতিদূরে। এই যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কালুবীরের বীরত্ব-কাহিনি এখনো বীরভূমের ঘরে ঘরে শোনা যায়। কালুবীর তো ডোমদের পূর্বপুরুষ। বীরবংশী বলে ডোমরা এখনো গর্ব অনুভব করে। বস্তুত, ‘ধর্মমঙ্গল’ ডোম কবিরই রচনা এবং বহু গ্রামে ধর্মপুজোর পুরোহিত ডোমরাই ছিল। অথচ সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক নিষ্পেশনে অন্ত্যজ জাতিগুলির কী ভয়াবহ অবনমন ঘটেছে!১১
রবীন্দ্রনাথের আদর্শে প্রাণিত শ্রীনিকেতনের কর্মীরা—কালীমোহন ঘোষ, এল্মহার্স্টের মতো সংস্কারকর্মী নেতারা সমবায়ের মাধ্যমে এইসব অঞ্চলের হাল ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন। সমবায়ের ভিত্তি হলো—পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও সহানুভূতি। ব্যক্তিগত লোভ যথাসম্ভব সংবরণের চেষ্টা করা। কালীমোহনের অভিজ্ঞতা—“মুসলমানপল্লীতে যে প্রাণ ও ঐক্য দেখিতে পাই, হিন্দুপল্লীতে তাহার অত্যন্ত অভাব বলিয়া তথায় সমবায় প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তোলা অধিকতর কষ্টকর ব্যাপার। সমাজ সংস্কারের দ্বারাই হিন্দুসমাজে প্রাণসঞ্চার করিতে হইবে। বর্তমানে সর্বপ্রধান কাজ অস্পৃশ্যতা দূর করা।” গান্ধির অমোঘ বাণী ছিল— “অস্পৃশ্যতা দূর না করা পর্যন্ত স্বরাজ-পতাকা স্পর্শ করিবার অধিকার আমাদের নাই।”১২ কালীমোহন ঘোষই এই বার্তার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।
সমবায়ের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ডেনমার্কের দৃষ্টান্ত দিতেন। ইউরোপের অন্য কয়েকটি দেশেও সমবায়নীতির আন্দোলনের কথা আমরা জানি। কালীমোহন ঘোষ তাঁর ‘কর্মী সংগঠন’ নিবন্ধে ডেনমার্ক ছাড়া চেকোস্লোভাকিয়া, যুগোস্লাভিয়া এবং প্যালেস্টাইনের কথাও বলেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ১৯৩০-৩১ সালে মূলত এল্মহার্স্টের উৎসাহ ও উদ্যোগে কালীমোহন ঘোষ দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করেছিলেন। স্ক্যান্ডানেভিয়া থেকে ইস্রায়েলে তিনি ঘুরেছিলেন। এই পর্যটনের একটিই উদ্দেশ্য ছিল—গ্রামোন্নয়ন পরিকল্পনা ও সমবায় প্রথা বিষয়ে সম্যক জ্ঞানার্জন করা। স্বদেশে ফিরে এসে এক বছরের মধ্যে শ্রীনিকেতন-সংলগ্ন দশটি গ্রামে কালীমোহন ‘সমবায়-স্বাস্থ্য সমিতি’ গড়ে তুলেছিলেন।
১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথও রুশভ্রমণে গিয়েছিলেন। রাশিয়া ঘুরে কবি যখন আমেরিকার পথে, সেই সময় ৯ অক্টোবর ১৯৩০-এ রবীন্দ্রনাথ কালীমোহনকে চিঠিতে জানাচ্ছেন : “সোভিয়েত রাষ্ট্রসঙ্ঘে একটি কো-অপরেটিভ সোসাইটি আছে, শ্রমিকদের জন্য বাসা নির্মাণ যার প্রধান কর্তব্য; সেই সোসাইটির নাম বিশ্রান্তিনিকেতন—The Home of Rest।” বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়াতে অভিজাত শ্রেণির মানুষদের জন্য যে বড় বড় প্রাসাদ ছিল, তাদের মধ্যেই একটিতে ‘অল্গভো’ নাম দিয়ে একটি কো-অপারেটিভ স্বাস্থ্যাগারের কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এই চিঠিতেই। এই অল্গভোও ছিল এই সমবায় প্রকল্পের অংশ। কবি জানিয়েছিলেন : “এমনতরো আরো চারটে সানাটোরিয়ম এর হাতে আছে। খাটুনির ঋতুকাল শেষ হয়ে গেলে অন্তত ত্রিশ হাজার শ্রমক্লান্ত এই পাঁচটি আরোগ্যশালায় এসে বিশ্রাম করতে পারবে। প্রত্যেক লোক একপক্ষ কাল এখানে থাকতে পারে। আহারের ব্যবস্থা পর্যাপ্ত, আরামের ব্যবস্থা যথেষ্ট, ডাক্তারের ব্যবস্থাও আছে। কোঅপরেটিভ প্রণালীতে এইরকম বিশ্রান্তিনিকেতন স্থাপনের ক্রমশই সাধারণের সম্মতি লাভ করছে।”১৩
রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছেন, শ্রমিকদের বিশ্রামের প্রয়োজন এমনভাবে আর কোথাও চিন্তা করা হয়নি। আমাদের দেশের অবস্থাপন্ন বড়লোকদের পক্ষেও এরকম সুযোগ দুর্লভ। বলা বাহুল্য, এইসব দৃষ্টান্ত কালীমোহনের মতো ন্যায়নিষ্ঠ ত্যাগব্রতীদের আরো বেশি করে উজ্জীবিত করে তুলত। কালীমোহন তাঁর রচনায় নিজেও জানিয়েছেন—ডেনমার্কের পন্থা অনুসরণ করে যুগোস্লাভিয়ার নবগঠিত জাতিও বয়স্ক কৃষকদের জন্য জেলায় জেলায় সামার স্কুল তৈরি করেছে। শ্রীনিকেতনের নেতৃত্বে তাঁরাও অনুরূপ স্কুল গড়ে তুলতে চান; সমবায়ের আদর্শে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, চাষবাসের কেন্দ্র, শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপন করতে চান। সেসব কাজ শুরুও হয়েছিল। কৃষি, গোপালন, পক্ষিপালন, পল্লিশিল্প, পল্লির অর্থনীতি, পল্লিশিক্ষা, পল্লিস্বাস্থ্য ইত্যাদির জন্য ব্যাপক কর্মকাণ্ড শ্রীনিকেতনে শুরু হয়েছিল।১৪ এল্মহার্স্ট প্রত্যক্ষভাবে খুব বেশি বছর থাকতে পারেননি শ্রীনিকেতনে (যদিও আমৃত্যু তিনি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন), কালীমোহন ঘোষদের দায়িত্ব তাই ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, সমস্ত প্রতিষ্ঠানেই সংগঠনগত সমস্যা ও দলাদলি তৈরি হয়ে যায়। শান্তিনিকেতন ও শ্রীিনকেতনও তার থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। কালীমোহন ঘোষের মতো নিঃস্বার্থ মানুষও আঘাত পেয়েছেন বিশ্বভারতীর কিছু কিছু কর্মকর্তার আচার-আচারণে। সেই আঘাত একটা সময়ে এতটাই তীব্র হয়েছিল যে, ১৯৩৩ সালে কালীমোহন তাঁর ‘গুরুদেব’কে চিঠিতে জানালেন : “আপনাকে আরেক দুঃখের সংবাদ দিতেছি। অদ্য প্রাতে আমি শ্রীনিকেতনের কর্মে পদত্যাগ করিয়াছি। গভীর বেদনার সহিত আমার প্রতি আমি এই নিষ্ঠুর আঘাত করিতে বাধ্য হইয়াছি।… এখানকার Influential সহকর্মীগণ বারবার কথা প্রসঙ্গে জানাইয়াছেন যে, আমি যেন তাঁহাদের কর্ম্মের পথে অন্তরায়। এই অবস্থায় অনেক বিবেচনার পর এই পদত্যাগপত্র দিয়াছি।”১৫
এই ঘটনার সময় রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় ছিলেন। ২ মে ১৯৩৩ তারিখে পত্রপাঠ কবি কালীমোহনকে লিখলেন : “কল্যাণীয়েষু, তুমি কাজে ইস্তফা দিয়েচ এ হতেই পারে না। তোমাকে কোনোমতেই ছুটি দিতে পারব না। তুমি গেলেই চলবে না। কার সঙ্গে তোমার কী অনৈক্য হয়েচে তা নিয়ে তুমি মন খারাপ করে এত বড়ো কাজ মাটি কোরো না। যারা তোমার মূল্য বোঝে না তাদের উপর আমি শ্রদ্ধা করতে পারিনে। যাই হোক দশজনে একসঙ্গে কাজ করতে হলে এরকম মনান্তর মতান্তর হয়েই থাকে, তা নিয়ে তুমি ক্ষুব্ধ হোয়ো না—জেনো তোমার উপর আমাদের সম্পূর্ণ নির্ভর আছে। তোমার কর্মত্যাগপত্র আমরা কিছুতে স্বীকার করব না।”১৬
এই চিঠির পর কালীমোহনের আর কোনো গত্যন্তর ছিল না, পরিপূর্ণভাবে আবার তিনি নিজেকে সঁপে দিলেন শ্রীনিকেতনের কাজে। পায়ে হেঁটে রোদে-জলে ঘুরে অশক্ত কালীমোহন প্রাণপাত করেছিলেন শ্রীনিকেতনের কর্মকাণ্ডে। যখন মোটরগাড়ি এসেছে শান্তিনিকেতনে, কালীমোহন ঘোষ কখনো সে-গাড়ি ব্যবহার করেননি। গাড়ির প্রয়োজন হলে তাঁর বাহন ছিল গরুর গাড়ি। অবিশ্রান্ত কাজের বোঝা বয়ে এবং অনিয়মিত জীবনযাপনের ফলে ১৯৩৯ সালে তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, শরীর শিথিল হয়ে পড়ে; ফলে ১৯৩৯ সালের ২২ নভেম্বর তাঁকে অবসর নিতেই হয়। আর এর কয়েক মাস পরেই ১৯৪০-এর ১০ মে তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ ঘটল। তখন তাঁর বয়স মাত্র আটান্ন বছর (মতান্তরে ছাপান্ন বছর)।
তথ্যসূত্র
১. চট্টোপাধ্যায়, পূর্ণানন্দ, কবি ও কর্মী : রবীন্দ্রনাথ ও কালীমোহন ঘোষ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৭, পৃঃ ২০
২. ঐ, পৃঃ ১৪
৩. ঐ, পৃঃ ২৬
৪. ঐ, পৃঃ ২৮
৫. ঐ, পৃঃ ১৬
৬. ঐ, পৃঃ ১৪৬
৭. ঐ
৮. ঐ, পৃঃ ১৪৭-৪৮
৯. ঐ, পৃঃ ১৪৯-৫০
১০. দ্রঃ ঐ, পৃঃ ১৫২-৫৩
১১. দ্রঃ ঐ, পৃঃ ১৫৪
১২. ঐ, পৃঃ ১৫৫-৫৬
১৩. ঐ, পৃঃ ৫৩
১৪. দ্রঃ ঐ, পৃঃ ১৬০
১৫. ঐ, পৃঃ ১৯
১৬. ঐ, পৃঃ ৫৪-৫৫
‘হেমচন্দ্র ঘোষ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।
রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, বর্তমান সম্পাদক, ‘পরিচয়’ পত্রিকা