শ্রীমদ্ভাগবত-এ ভক্তির নয়টি প্রকার বলা হয়েছে :

“শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ স্মরণং পাদসেবনম্‌।
অর্চনং বন্দনং দাস্যং সখ্যমাত্মনিবেদনম্‌॥”

ভক্তিপ্রসঙ্গে দেবর্ষি নারদ বলছেন : ‘কথাদিষু ইতি গর্গঃ’২—গর্গ মুনি ভগবৎকথা শ্রবণ ও কীর্তনকেই ভক্তি বলছেন। তাই দেখা যায় যে, কোনো ব্রত, উপবাস, পূজা ও জপকর্মের অন্তে সাধক ইষ্টদেবের স্মরণার্থ স্তবপাঠ, মাহাত্ম্যকীর্তন, সংগীত ইত্যাদি করে থাকেন। বিভিন্ন দেবদেবীর স্তবস্তুতিপাঠ কমবেশি সকল ভক্ত সর্বত্র করে থাকেন। বিশেষ উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য অনুষ্ঠিত পূজাদির ক্ষেেত্র সেই সেই দেবদেবীর মাহাত্ম্যকথা পাঠ করতে দেখা যায়—যেমন সত্যনারায়ণের পাঁচালি, ল‌ক্ষ্মীর পাঁচালি, শিবরাত্রি ব্রতকথা, জন্মাষ্টমী ব্রতকথা প্রভৃতি। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা দার্শনিক তত্ত্বপূর্ণ শ্রীভগবানের মুখনিঃসৃত ও তাঁর হৃদয়স্বরূপ (‘গীতা মে হৃদয়ং পার্থ’)৩ হলেও জন্মাষ্টমী, গীতাজয়ন্তী, শ্রাদ্ধবাসর ইত্যাদি কয়েকটি স্থলে তার পাঠ প্রচলিত। কিছু পুরাণগ্রন্থ—যেমন প্রায়শ্চিত্তাদি ক্ষেত্রে বিহারাদি পশ্চিমাঞ্চলে গরুড়পুরাণ পাঠ হয়ে থাকে। আবার তীর্থ‌ক্ষেত্রে কাশীখণ্ড প্রভৃতির বিধিপূর্বক পাঠ ও শ্রবণের বিধান আছে। কিন্তু মার্কণ্ডেয়পুরাণ-এর অন্তর্গত ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ বা ‘দেবীমাহাত্ম্য’ বা ‘সপ্তশতী-চণ্ডী’ পাঠ বিবিধ উপল‌ক্ষে সর্বত্র বিশেষ প্রচলিত। শ্রীশ্রীচণ্ডীর দ্বাদশ অধ্যায়ে চণ্ডীমাহাত্ম্য বর্ণনায় বলা হয়েছে :

“তস্মান্মমৈতন্মাহাত্ম্যং পঠিতব্যং সমাহিতৈঃ।
শ্রোতব্যঞ্চ সদা ভক্ত্যা পরং স্বস্ত্যয়নং হি তৎ॥”

—অতএব আমার এই মাহাত্ম্য সমাহিতচিত্তে নিত্য ভক্তিপূর্বক পাঠ বা শ্রবণ করা কর্তব্য। কারণ, তা অতিশয় মঙ্গলজনক।

এখানে ‘স্বস্ত্যয়নং’ শব্দের ব্যাখ্যায় টীকাকার নাগোজীভট্ট বলেছেন : ‘স্বস্তি কল্যাণং তস্য অয়নং মার্গঃ’৫—যে-উপায় দ্বারা স্বস্তি বা কল্যাণ লাভ হয় তাকে স্বস্ত্যয়ন বলে। শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠ ও শ্রবণ হলো সর্বশ্রেষ্ঠ স্বস্ত্যয়ন, কারণ এর দ্বারা সাধকের সর্বাভীষ্ট সিদ্ধ হয়। একাগ্রচিত্তে চণ্ডীপাঠের ফলে সকাম সাধক ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখলাভ করেন এবং মুমু‌ক্ষ ব্যক্তি পরম নিঃশ্রেয়স বা মুক্তিলাভ করে ধন্য হন।

দেবীভাগবত-এ দেবীমাহাত্ম্য শ্রবণে অশ্বমেধযজ্ঞের ফলপ্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে :

“কো হি দেব্য গুণান্‌ শৃণ্বংস্তৃপ্তিং যাস্যতি শুদ্ধধীঃ।
পদে পদেঽশ্বমেধস্য ফলম‌ক্ষয্যমশ্নুতে॥”

ভগবৎকথা শ্রবণে যে সাধকের চিত্তে ক্রমশ ভগবদ্ভক্তির উদয় হয়, সেবিষয়ে পরমভাগবত মহারাজ পরী‌ক্ষিৎ বলেছেন :

“শৃণ্বতঃ শ্রদ্ধয়া নিত্যং গৃণতশ্চ স্বচেষ্টিতম্‌।
নাতিদীর্ঘেণ কালেন ভগবান্‌ বিশতে হৃদি॥”

দেবীমাহাত্ম্য বা শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে স্বয়ং ভগবতী বলছেন :

“এভিঃ স্তবৈশ্চ মাং নিত্যং স্তোষ্যতে যঃ সমাহিতঃ।
তস্যাহং সকলাং বাধাং নাশয়িষ্যাম্যসংশয়ম্‌॥”

তত্ত্বপ্রকাশিকা টীকায় শ্রীমদ্‌ গোপাল চক্রবর্তী বলেন—এই দেবীমাহাত্ম্য ধর্ম, অর্থ, কাম ও মো‌ক্ষ চতুর্বিধ পুরুষার্থ লাভের সাধনস্বরূপ। ‘এভিঃ স্তবৈঃ’ বাক্যে শ্রীশ্রীচণ্ডীর চারটি স্তবের কথাই উল্লেখ করা হয়। সেগুলি হলো—(১) প্রথম অধ্যায়ে ব্রহ্মাকৃত ‘ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা’ ইত্যাদি স্তব, (২) চতুর্থ অধ্যায়ে মহিষাসুর বধের পর শক্রাদি দেবগণের স্তুতি—‘দেব্যা যয়া ততমিদং জগদাত্মশক্ত্যা’, (৩) পঞ্চম অধ্যায়ে বর্ণিত শুম্ভ-নিশুম্ভের অত্যাচারে উৎপীড়িত দেবগণ-কৃত ‘নমো দেব্যৈ মহাদেব্যৈ’ ইত্যাদি স্তব এবং (৪) একাদশ অধ্যায়ে শুম্ভ-নিশুম্ভ বধান্তে ‘দেবি প্রপন্নাির্তহরে প্রসীদ’ ইত্যাদি নারায়ণী স্তুতি। এতদ্ব্যতীত সমগ্র চণ্ডীতে কেবল যুদ্ধাদির বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু বারাহীতন্ত্রে সমগ্র গ্রন্থই স্তবরূপে বলা হয়েছে:

“যথাশ্বমেধঃ ক্রতুরাট্‌ দেবানাঞ্চ যথা হরিঃ।
স্তবানামপি সর্বেষাং তথা সপ্তশতীস্তবঃ॥”


যামলতন্ত্রেও সমগ্র সপ্তশতী স্তবরূপে পাঠ্য বলা হয়েছে :

পঠেদারভ্য সাবর্ণিঃ সূর্যতনয় আদিতঃ।
সমাপয়েত্তু তস্যান্তে সাবর্ণির্ভবিতা মনুঃ॥”১০

চণ্ডীপাঠের মাহাত্ম্যে ‘স্তোষ্যতে যঃ সমাহিতঃ’ বাক্যে সমাহিত বা একাগ্রচিত্তে পাঠে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ছান্দোগ্যোপনিষদে স্তবপাঠ সম্বন্ধে বলা হয়েছে : “আত্মানমন্তত উপসৃত্য স্তুবীত কামং ধ্যায়ন্নপ্রমত্তোঽভ্যাশো হ যদস্মৈ স কামঃ সমৃধ্যেত যৎকামঃ স্তুবীতেতি যৎকামঃ স্তুবীতেতি॥”১১ অর্থাৎ, অবশেষে আপনাকে চিন্তাপূর্বক অপে‌ক্ষিত ফলের চিন্তা করে বর্ণোচ্চারণে প্রমাদশূন্য হয়ে স্তব করবেন। তাহলে যে-কর্মে যেরূপ কামনাযুক্ত হয়ে স্তব করবেন, সেই কর্মে তাঁর সেই অভীষ্ট ফল অতি শীঘ্র সমৃদ্ধিলাভ করবে।

নিত্য সমাহিতচিত্তে দেবীমাহাত্ম্য বা শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠ, শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ করলে দিব্যজীবন লাভের পথে সকল বাধা বিনষ্ট হয়। কারণ, শ্রেয়োলাভের পথ অতি দুর্গম, ক্ষুরের ধারের মতো তী‌ক্ষ্ণ বলে শ্রুতি জানিয়েছেন। অতএব সমাহিতচিত্তে স্তবপাঠ সহায়ে সাধকের হৃদয়ে নিয়ত বাধাপ্রশমনকরী জগন্মাতার স্বরূপ-চিন্তন ও শরণাগতচিত্তে তাঁর নিকট ঐকান্তিক প্রার্থনা শ্রেয়োলাভের পথে বাধাসকলকে ভস্মীভূত করে। বিষ্ণুর নিরন্তর চিন্তনের ফল—যা ভাগবতে বলা হয়েছে, তা এখানেও প্রযোজ্য

“যথা হেম্নি স্থিতো বহ্নির্দুর্বর্ণং হন্তি ধাতুজম্‌।
এবমাত্মগতো বিষ্ণুর্যোগিনামশুভাশয়ম্‌॥”১২

শ্রীশ্রীচণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্য পাঠ করলে মহামারীজনিত আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক সকল প্রকার উপদ্রব অচিরেই বিনষ্ট হয়। সেজন্য শ্রীশ্রীচণ্ডীর দ্বাদশ অধ্যায়ে মাহাত্ম্য বর্ণনা করে স্বয়ং দেবী বলছেন :

“উপসর্গানশেষাংস্তু মহামারীসমুদ্ভবান্‌।
তথা ত্রিবিধমুৎপাতং মাহাত্ম্যং শময়েন্মম॥”
“উপসর্গাঃ শমং যান্তি গ্রহপীড়াশ্চ দারুণাঃ।
দুঃস্বপ্নঞ্চ নৃভির্দৃষ্টং সুস্বপ্নমুপজায়তে॥”১৩

এরূপ ফলদায়ী শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু বিধি না জানায় বিধিভঙ্গের অপরাধে অনিষ্টাশঙ্কায় অনেকেই পিছিয়ে যান। তাই বহুজনের এই বিধি বিষয়ে জানার আগ্রহ দেখে আমরা চণ্ডীপাঠের শাস্ত্রবিধিসকল উল্লেখ করব।

শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠ নিত্য ও নৈমিত্তিক দু-প্রকারে করা যায়। কোনো পর্ব উপল‌ক্ষে বা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যসিদ্ধির নিমিত্ত যে পাঠ করা হয়, তাকে নৈমিত্তিক পাঠ বলে। দেবী ভগবতী স্বয়ং দ্বাদশ অধ্যায়ে বলেছেন :

“অষ্টম্যাঞ্চ চতুর্দশ্যাং নবম্যাঞ্চৈকচেতসঃ।
শ্রোষ্যন্তি চৈব যে ভক্ত্যা মম মাহাত্ম্যমুত্তমম্‌॥”১৪

এছাড়া পূর্বকথিত মহামারী ইত্যাদি সময়েও অনিষ্টনাশের জন্য পাঠ কর্তব্য বলা হয়েছে। এসকলই নৈমিত্তিক পাঠ। পশু, পুষ্পার্ঘ্য, ধূপ, দীপ, ব্রাহ্মণভোজন, হোম ও স্নানজল, বিবিধ ভোগ এবং দ‌ক্ষিণা দ্বারা একবছর দিবানিশি দেবীর পূজা করলে যে-ফল পাওয়া যায়, সমাহিতচিত্তে শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠ করলে সেই ফল প্রাপ্ত হয়—একথা দেবী স্বয়ং বলেছেন। এই পাঠের নিয়মগুলি একান্তভাবে জানা প্রয়োজন। তাই এখানে সেগুলি বলা হচ্ছে—

(১) শুদ্ধভাবে স্নানাহ্নিকাদি নিত্যকর্ম সমাপন করে দেবী চণ্ডীর পূজা করতে হয়।
(২) দেবী চণ্ডীর পূজা শিবলিঙ্গে, চণ্ডীপুস্তকে, মণ্ডলে, প্রতিমায়, যন্ত্রে, জলে বা শালগ্রাম শিলায় করতে হয়—

“লিঙ্গস্থাং পূজয়েদ্দবীং পুস্তকস্থাং তথৈব চ।
মণ্ডলস্থাং মহামায়াং যন্ত্রস্থাং প্রতিমাসু চ।
জলস্থাং বা শিলাস্থাং বা পূজয়েৎ পরমেশ্বরীম্‌॥”১৫


(৩) দেবীর পূজার পুষ্প অপরাজিতা, জবা, শ্বেত ও রক্তকরবী এবং দ্রোণপুষ্প। কারণ, এই সকল যন্ত্রপুষ্পে দেবী বাস করেন—

“যত্রাপরাজিতাপুষ্পং জবাপুষ্পঞ্চ বিদ্যতে।
করবীরে শুক্লরক্তে দ্রোণঞ্চ যত্র তিষ্ঠতি।
তত্র দেবী বসেন্নিত্যং তদ্‌যন্ত্রে চণ্ডিকার্চনম্‌॥”১৬

(৪) পবিত্র মনে ভক্তিভাবে বিশুদ্ধ উচ্চারণে অর্থবোধ সহকারে পাঠ কর্তব্য।

(৫) কোনো আধারে চণ্ডীপুস্তক রেখে পাঠ করতে হয়, হাতে ধরে নয়—

“আধারে স্থাপয়িত্বা তু পুস্তকং পূজয়ে‌ৎ সুধীঃ।

 হস্তসংস্থাপনাদেব যস্মাদ্বৈ বিফলং ভবেৎ॥”১৭

(৬) পুস্তক না দেখে মুখস্থ পাঠই বিধেয়। অ‌ক্ষম হলে আধারে পুস্তক রেখে উচ্চারণ, যতি, ছন্দ ঠিক রেখে পাঠ কর্তব্য। দীর্ঘস্বরে, হ্রস্বস্বরে, গানের আকারে, মস্তক দোলাতে দোলাতে পাঠ অনুচিত। যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন :

“গীতী শীঘ্রী শিরঃকম্পী স্বয়ংলিখিতপাঠকঃ।

অনর্থজ্ঞোঽল্পকণ্ঠশ্চ ষড়েতে পাঠকাধমঃ॥”১৮

পাঠ চলাকালীন কারো সঙ্গে কথা বলা, বিশ্রাম নেওয়া, হাই তোলা, ঘুমানো, থুতু ফেলা, হাঁচি প্রভৃতি বর্জনীয়। কোনোভাবে এরূপ ঘটলে আচমন, দ‌ক্ষিণকণ্ঠ স্পর্শ ও বিষ্ণুস্মরণপূর্বক অধ্যায়ের প্রথম থেকে পাঠ কর্তব্য।
(৭) নিজে পাঠে অ‌ক্ষম হলে কোনো সদাচারী পণ্ডিত ব্রাহ্মণ দ্বারা পাঠ করাতে হয়। চণ্ডীপাঠ সকল বর্ণের মানুষ করতে পারে। কেবল অপরের জন্য ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য বর্ণের অধিকার নেই।
(৮) ষড়ঙ্গ পাঠ করে চণ্ডীপাঠ করতে হয়। দেবীসূক্ত, অর্গলাস্তোত্র, কীলকস্তব, দেবীকবচ পাঠ করে শ্রীশ্রীচণ্ডীর ১৩টি অধ্যায় ও পরে রহস্যত্রয় পাঠ বিধেয়—

“অর্গলং কীলকং চাদৌ পঠিত্বা কবচং পঠেৎ।
জপেৎ সপ্তশতীং পশ্চাৎ ক্রম এষঃ শিবোদিতঃ॥”১৯


আবার কেবলমাত্র কুঞ্জিকাস্তোত্র পাঠেই সমগ্র ফলপ্রাপ্তির বিধান দেখা যায়—


“কবচং নার্গলাস্তোত্রং কীলকং ন রহস্যকম্‌।
ন সূক্তং নাপি ধ্যানং চ ন ন্যাসং ন চ বাঽর্চনম্‌।
কুঞ্জিকাপাঠমাত্রেণ দুর্গাপাঠফলং লভেৎ॥”২০


(৯) অশুদ্ধ পাঠ উচিত নয়। সেজন্য যথাযথ উচ্চারণবিধি জেনে তদনুযায়ী পাঠ করাই কর্তব্য। নচেৎ বহুবিধ অনিষ্টের আশঙ্কা থাকে। উচ্চারণবিধি অভিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট জেনে নিতে হয়, লিখে জানানো সম্ভব নয়।

(১০) বিশেষ পর্ব উপল‌ক্ষে বা বিশেষ কারণে যেখানে একই দিনে এক ব্যক্তিকে দুই-তিনরূপ দেবীমাহাত্ম্য পাঠ করতে হয় সেখানে দেবীসূক্ত, অর্গলাস্তোত্র, কীলকস্তব কবচ ও ঋষ্যাদি ন্যাস করে একরূপ পাঠ করণীয়। দ্বিতীয় বা তৃতীয় রূপে প্রথম অধ্যায় থেকে পাঠ করা যায়; দেবীসূক্ত, অর্গলাস্তোত্র প্রভৃতি পাঠ না করলেও চলে।

(১১) চণ্ডীপাঠের ক্রমটি এরকম—প্রথমে দেবীকে পূজা করে চণ্ডীগ্রন্থ খুলে দেবীসূক্ত, অর্গলাস্তোত্র, কীলকস্তব, দেবীকবচ পাঠ করে দেবীমাহাত্ম্য পড়তে হয়—

“দেবার্চামগ্রতঃ কৃত্বা ব্রাহ্মণানাং বিশেষতঃ।
গ্রন্থিঞ্চ শিথিলং কুর্যাদ্বাচকঃ কুরুনন্দন॥
অর্গলং কীলকঞ্চাদৌ পঠিত্বা কবচং পঠেৎ।
জপেৎ সপ্তশতীং পশ্চাৎ ক্রম এষঃ শিবোদিতঃ॥”২১

পাঠশেষে গ্রন্থ বন্ধ করতে হয়, মুক্ত রাখার নিয়ম নেই। শেষ অধ্যায়ের শেষ শ্লোকটি দুবার পাঠ করতে হয়।

(১২) চণ্ডীপাঠে যেমন দেবীর কৃপালাভ হয়, সেরূপ দেবীসূক্ত পাঠ করলেও তাঁর কৃপালাভ হয়। শ্রীশ্রীচণ্ডীর ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে—রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য তপস্যাকালে দেবীসূক্ত পাঠ করতেন (‘দেবীসূক্তং পরংজপন্‌’); কারণ তখনো চণ্ডীগ্রন্থ রচিত হয়নি। সেজন্য তাঁরা ঋগ্বেদোক্ত দেবীসূক্ত ‘অহং রুদ্রেভিঃ’ ইত্যাদি প্রথমে পাঠ করতেন। সেকারণে দেবীসূক্ত অগ্রে পাঠ্য, কারণ তা বৈদিক মন্ত্র। নবার্ণ মন্ত্র জপের বিধান রয়েছে। নব+অর্ণ অর্থাৎ নয়টি বর্ণ বিশিষ্ট মন্ত্র। এটি সিদ্ধমন্ত্র। এই মন্ত্রটি দুই রূপে পাওয়া যায়—(১) ‘ওঁ ঐঁ হ্রীঁ ক্লীঁ হ্লীঁ হ্রীঁ ক্লীঁ নমঃ।’ (২) ‘ঐঁ হ্রীঁ ক্লীঁ চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে।’২২ মন্ত্রার্থ—হে চিদানন্দরূপিণি ব্রহ্মমহিষি চণ্ডি, ব্রহ্মবিদ্যালাভের জন্য আমরা তোমার ধ্যান করি, তুমি আমাদের দুঃখ হরণ কর।

(১৩) কেউ কেউ বলেন—রাত্রিকালে চণ্ডীপাঠ নিষিদ্ধ। কিন্তু রাত্রিসূক্ত পাঠ করে রাত্রিকালেও পাঠ করা যায়। রুদ্রযামল ও বারাহী তন্ত্রে দিবা বা রাত্রিতে চণ্ডীপাঠ বিহিত বলা হয়েছে—

“ইত্যেবং হি মহামন্ত্রান্‌ পঠিত্বা পরমেশ্বরি।
চণ্ডীপাঠং দিবারাত্রৌ কুর্যাদেব ন সংশয়ঃ॥”২৩
“সপ্তাভিঃ শতসংখ্যায়াঃ পদ্যরূপাপ্যনুত্তমা।
নাম্না সপ্তশতী দেবী জাপ্যাধীরৈর্দিবানিশম্‌”॥২৪

নৈমিত্তিক পাঠে এসকল নিয়মপালনপূর্বক একাগ্রচিত্তে পাঠ করলে ফলপ্রাপ্তি হয়। যাঁরা নিত্য চণ্ডীপাঠ করেন, তাঁদেরও এই নিয়মগুলি-সহ পাঠ অবশ্যই ফলদায়ী। পরন্তু সময়ের অভাব, ভাষার অনভিজ্ঞতা তাঁদের সকল নিয়মপালনে প্রতিবন্ধক হয়। সে‌ক্ষেত্রে বলি, পূজা-আহ্নিকাদির শুদ্ধিতা, পবিত্রতা, ভক্তিযুক্তচিত্ত হওয়া অবশ্য প্রয়োজন। সময়ের অভাব হেতু তাঁরা সম্পূর্ণ পাঠে অসমর্থ হয়ে প্রথম দিনে—প্রথম চরিত (প্রথম অধ্যায়), দ্বিতীয় দিনে—মধ্যম চরিত (দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অধ্যায়) এবং তৃতীয় দিনে—উত্তর চরিত (পঞ্চম থেকে ত্রয়োদশ অধ্যায়) পাঠ করবেন। তাতেও অ‌ক্ষম হলে কেবল মধ্যম চরিত পাঠের বিধান আছে। বারাহীতন্ত্রে বলা হয়েছে—

“ততঃ কৃতাঞ্জলির্ভূত্বা স্তুবীত চরিতৈরিমৈঃ।
একেন বা মধ্যমেন নৈকেনেতরয়োরিহ।
চরিতার্ধন্তু ন জপেজ্জপংশ্ছিদ্রমবাপ্নুয়াৎ॥”২৫

করজোড়ে এক এক চরিত পাঠ্য। আবার দেবী স্বয়ং দ্বাদশ অধ্যায়ে ‘এভিঃ স্তবৈঃ’ ইত্যাদি বাক্যে চারটি স্তুতিপাঠের কথা বলেছেন। পরন্তু তা একাগ্রচিত্তে ভক্তিসহকারে পাঠ্য।

মা হলেন সন্তানের একমাত্র অবলম্বন। বিপদে-আপদে, সম্পদে-আনন্দে সর্বত্র মা সন্তানের পরম আশ্রয়। জগন্মাতা ভগবতী জীবের সংসার-মুক্তির হেতু, আবার তিনি সংসার-বন্ধনের কারণও হন—

“সা বিদ্যা পরমা মুক্তের্হেতুভূতা সনাতনী।
সংসারবন্ধহেতুশ্চ সৈব সর্বেশ্বরেশ্বরী॥”২৬

সুতরাং সেই দেবী ভগবতীর প্রসন্নতালাভই সাধকের একমাত্র কাম্য। দেবীর প্রসন্নতালাভের জন্য সাধকের একমাত্র অবলম্বন শুদ্ধাভক্তি। শুদ্ধ, একান্ত, অনন্য ভক্তিই দেবীর কৃপালাভে সহায়ক। ‘সৈষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে’২৭—তিনি প্রসন্না হলে বরদা হয়ে মনুষ্যের মুক্তির কারণ হন। তিনি তখন হাত বাড়িয়ে দেন।

তথ্যসূত্র

১. শ্রীমদ্ভাগবতম্‌, ৭।৫।২৩
২. নারদীয় ভক্তিসূত্র, ১৭
৩. গীতা মাহাত্ম্যম্, ১
৪. স্বামী জগদীশ্বরানন্দ (অনূদিত ও সম্পাদিত), শ্রীশ্রীচণ্ডী, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০০৮, ১২।৭
৭. হরিকৃষ্ণ শর্মা (সম্পাদক), দুর্গাসপ্তশতী সপ্তটীকা, বেঙ্কটেশ্বর প্রেস, মুম্বাই, ১৯১৬, পৃঃ ২৫৯
৮. দেবীভাগবতম্‌, ৭।২৮।২৩
৯. শ্রীমদ্ভগবতম্‌, ২।৮।৪
১০ শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১২।২
১১. দ্রঃ শ্রীরাসমোহন চক্রবর্তী (সম্পাদক), শ্রীশ্রীচণ্ডী, মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য এণ্ড কোং, কলিকাতা, ১৩৬০, পৃঃ ৫১৪
১২. ঐ
১৩. ছান্দোগ্যোপনিষদ, ১।৩।১২
১৪. শ্রীমদ্ভাগবতম্‌, ১২।৩।৪৭
১৫. শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১২।৮, ১৭
১৬. ঐ, ১২।৪
১৭. ঐ, পৃঃ ১, পাদটীকা

১৮. ঐ, পৃঃ ২, পাদটীকা
১৯. দ্রঃ বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী (সম্পাদক), শান্তি-স্বস্ত্যয়ন কৌমুদী, নবভারত পাবলিশার্স, কোলকাতা, ১৪২২, পৃঃ ৩০০
২০. দ্রঃ ঐ, পৃঃ ৩০১
২১. দ্রঃ ঐ
২২. শ্রীশ্রীচণ্ডী, পৃঃ ৪০০
২৩. দ্রঃ শান্তি-স্বস্ত্যয়ন কৌমুদী, পৃঃ ৩০২
২৪. শ্রীশ্রীচণ্ডী, পৃঃ ৪
২৫. দ্রঃ শান্তি-স্বস্ত্যয়ন কৌমুদী, পৃঃ ৩০২
২৬. দ্রঃ ঐ
২৭. দ্রঃ ঐ
২৮. শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১।৫৭-৫৮
২৯. ঐ, ১।৫৭

‘স্বামী সারদানন্দ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।
অদ্বৈত আশ্রম, বারাণসী