“যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গলসাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন, তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।”১
রচনার দ্বিবিধ উদ্দেশ্যের কথা প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এখানে উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, দেশ বা মানুষের মঙ্গলসাধন। দ্বিতীয়ত, সৌন্দর্য সৃষ্টি। ‘কৃষ্ণচরিত্র’ রচনার পিছনে বঙ্কিমচন্দ্রের এই দুই উদ্দেশ্যের মধ্যে প্রথমটিই অধিক সক্রিয় ছিল বলে অনুমিত হয়। দেশ ও জাতির সামনে এমন একটি চরিত্রকে তিনি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন—যাঁর আদর্শ জাতিকে পথ দেখাবে, বলিষ্ঠতা দেবে; একটা পরাজিত, বহুকাল-নিপীড়িত, আত্মবিস্মৃত জাতির সামনে উদাহরণ হিসােব দাঁড়িয়ে যাবতীয় কাপুরুষতাকে জয় করতে শক্তি জোগাবে।
‘কৃষ্ণচরিত্র’ রচনার সূচনায় প্রাবন্ধিক গ্রন্থের উদ্দেশ্য, কৃষ্ণের চরিত্র কেমন ছিল তা জানার উপায় ইত্যাদি বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মহাভারতের ঐতিহাসিকতা, পাণ্ডবদের ঐতিহাসিকতা, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সম্ভাব্য সময়, কৃষ্ণচরিত্রের ঐতিহাসিকতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। এই বিষয়গুলি নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজনীয়তা একথা মনে করিয়ে দেয় যে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনুমান করেছিলেন—কৃষ্ণচরিত্রের নানা দিক আলোচিত হওয়ার আগে চরিত্রটি প্রকৃতই কতটা বাস্তব বা ইতিহাস-সমর্থিত সেবিষয়ে নিঃসন্দিগ্ধ হয়ে নেওয়া দরকার আছে। চরিত্রটির বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আগে সমকালের মানুষকে কৃষ্ণচরিত্রটির প্রকৃত অস্তিত্বের যৌক্তিকতা বিষয়ে নিঃসংশয় করে নেওয়া প্রয়োজন বলে তাঁর মনে হয়েছিল।
সমকালের মনোভাব তিনি জানতেন। তার্কিকতার সম্ভাব্য অস্ত্রগুলি কোনদিক থেকে আক্রমণ হানতে পারে তাও তিনি জানতেন। তাই আলোচনায় প্রবিষ্ট হওয়ার আগে সম্ভাব্য বিরোধিতাগুলির উত্তর আগাম সাজিয়ে নিয়েছেন, আর তারই সূত্রে তিনি প্রসঙ্গগুলির অবতারণা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের সমকালে এই বিষয়গুলি গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, বর্তমানের সাহিত্য আলোচনায় বিষয়গুলি ততটা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাহিত্য, ধর্ম, জীবনচর্যা যাই হোক না কেন, পৌরাণিক বা মহাকাব্যিক চরিত্র আলোচনা প্রসঙ্গে তার বাস্তব অস্তিত্বের প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে প্রশ্ন এখন আমরা সেভাবে কেউ তুলি না আর। বক্তব্য বিষয়ের যৌক্তিকতার দিকেই বর্তমান শতাব্দীর দৃষ্টি আবদ্ধ। কাজেই ‘কৃষ্ণচরিত্র’ আলোচনা প্রসঙ্গে সূচনালগ্নের এই বিষয়গুলির পর্যালোচনা আপাতত স্থগিত রেখে আমরা নিবন্ধের মূল অংশের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি।
কৃষ্ণের জন্ম, শৈশব, কৈশোরের সঙ্গে যে-কাহিনিগুলি জড়িত, সেই বৃত্তান্তগুিলকে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করে প্রাবন্ধিক দেখিয়েছেন প্রতিটি কাহিনি আসলে বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার রূপায়ণ। কালীয়-দমন বা পুতনা-বধ কিংবা বকাসুর-নিধন অথবা অঘাসুর-বধ—এর সবগুলিই প্রকৃতপক্ষে বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনা। কৃষ্ণ শৈশব থেকেই বলিষ্ঠ এবং নেতৃত্বদানের অধিকারী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর সেই বিশেষ প্রতিভার প্রকাশ নানাভাবে ঘটতে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় কৃষ্ণের শৈশবকালের ‘যমলার্জুনভঙ্গ’-এর বৃত্তান্তটির কথা। অবাধ্য কৃষ্ণকে শাস্তি দিতে মাতা যশোদা পেটে দড়ি বেঁধে একটি উদূখলের সঙ্গে আটকে রেখে যান। শিশু কৃষ্ণ উদূখল-সমেত দুই ‘যমলার্জুন’ গাছের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলে উদূখলের টানে গাছটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। এই অলৌকিক বৃত্তান্তটি প্রাবন্ধিক যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সেটি এইরূপ—“অর্জ্জুন বলে কুরচি গাছকে; যমলার্জ্জুন অর্থে জোড়া কুরচি গাছ। কুরচি গাছ সচরাচর বড় হয় না, এবং অনেক ছোট গাছ দেখা যায়। যদি চারাগাছ হয়, তাহা হইলে বলবান শিশুর বলে ঐরূপ অবস্থায় তাহা ভািঙ্গয়া যাইতে পারে।”২ এমনই বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার আলোকে বঙ্কিমচন্দ্র ব্যাখ্যা করেছেন কৃষ্ণের চরিত্রটিকে। তাঁর জীবনের ঘটে যাওয়া বৃত্তান্তগুলি ক্রমশ আলোচিত হয়েছে এই আলোকে, আর তারই মধ্য থেকে ক্রমশই উঠে এসেছে এমন একটি চরিত্র—যিনি মানুষ হিসাবে শ্রেষ্ঠতম গুণগুলির আধার, দেবতা হিসাবে পুরুষোত্তম।
ব্রজগোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণ রাসলীলায় মত্ত হয়েছিলেন। সাধারণ দৃষ্টিতে এই রাসলীলা প্রমোদকলার অঙ্গ। সাধারণ জীবনে এই ধরনের লীলায় নৈতিক স্খলনের সম্ভাবনা প্রচুর, কিন্তু কৃষ্ণের কাছে তা লীলামাত্র। আর গোপীদের কাছে তা ঈশ্বরের উপাসনা। “চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির চরম অনুশীলন সেই বৃত্তিগুলিকে ঈশ্বরমুখী করা।” যিনি সুন্দর, যিনি অনন্তসুন্দর তাঁর আরাধনা স্ত্রীজাতির পক্ষে ‘জীবনসার্থকতার মুখ্য উপায়’। এমনটিই প্রাবন্ধিক বলেছেন। এ তো শুধু স্ত্রীজাতি সম্বন্ধে নয়, সব মানুষ সম্বন্ধেই সত্য। সংগীত, নৃত্য, ললিতকলার যাকিছু সে যে ঈশ্বর-উপাসনার শ্রেষ্ঠতম পথ—একথা রসতীর্থ পথের সাধক ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বারবার উচ্চারণ করেছেন। উচ্চারণ করেছেন স্বামী বিবেকানন্দও। গোপীগণ কৃষ্ণের সঙ্গে রাসলীলায় সেই পরম আনন্দের পথে যাত্রা করেছেন। আমরা দেখেছি, বৈষ্ণবীয় রসশাস্ত্রেও একথা বলা আছে—কৃষ্ণ তাঁর আনন্দের অংশ থেকেই জন্ম দিয়েছিলেন শ্রীরাধিকাকে; জন্ম দিয়েছিলেন গোপিনীদের।
গোপিনীদের ‘বস্ত্রহরণ’ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন—মহাভারত, বিষ্ণুপুরাণ বা হরিবংশে বস্ত্রহরণ প্রসঙ্গ নেই। আছে ভাগবতে। গোপিনীরা কৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার ইচ্ছায় কাত্যায়নীব্রত গ্রহণ করেছিলেন। এক মাস ধরে ভোরবেলায় সংঘবদ্ধভাবে এসে তাঁরা বস্ত্র পরিত্যাগ করে জলে নেমে স্নান করতেন। শেষদিনে শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের বস্ত্রগুলি হরণ করে কদম্ববৃক্ষে উঠে বসেন। গোপিনীদের লজ্জা বর্জন করে সেই বস্ত্র ফিরে পেতে হয়। ভাগবতের গভীর ভক্তিতত্ত্ব দিয়েই প্রাবন্ধিক এর প্রকৃত ব্যাখ্যা করেছেন। ভাগবত-রচয়িতা ২৯তম অধ্যায়ে জানিয়েছেন, এই গোপীরা পতিভাবে কৃষ্ণকে পাওয়ার সাধনা করেছিলেন। সেই কারণে তাঁরা ব্রত নিয়েছিলেন, স্নানে নেমেছিলেন। কৃষ্ণ তাঁদের সেই প্রার্থনাপূরণে বদ্ধপরিকর। কেননা তিনিই গীতায় বলেছেন—যে আমাকে যেভাবে সাধনা করে আমি তাকে সেইভাবেই ধরা দিই—“যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্।/ মম বর্ত্মানুবর্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্বশঃ।।”৩ গোপীরা পতিভাবে কৃষ্ণকে কায়মনোবাক্যে চেয়েছিলেন। কৃষ্ণ তাঁদের কাছ থেকে সেই সর্বস্বই চেয়ে নিয়েছেন। কৃষ্ণও তাই তাঁদের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। ভক্তিতত্ত্বের এই গভীর তত্ত্বই ‘বস্ত্রহরণ’ বৃত্তান্তে পরিবেশিত হয়েছে। শ্রীরাধিকা সেই গোপীদেরই শ্রেষ্ঠতম রূপ। যিনি কৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ আরাধিকা, তিনিই রাধিকা বা রাধা। ‘আরাধিকা’ থেকে ‘রাধিকা’ বা ‘রাধা’। ‘রাধা’ শব্দের দ্বিতীয় অর্থ বিশাখা নক্ষত্র। কৃত্তিকা থেকে রাশি গণনা করলে রাধা অর্থাৎ বিশাখা নক্ষত্র ঠিক মাঝখানে পড়ে। পূর্বে কৃত্তিকা থেকে বছরও গণনা করা হতো। রাধা শ্রেষ্ঠতম। তিনি রাসমণ্ডলীর প্রধান, রাশিমণ্ডলীরও প্রধান।
কংসবধ কৃষ্ণের জীবনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। হরিবংশ ও পুরাণে কংসবধের বৃত্তান্ত আছে। কৃষ্ণ কংসকে হত্যা করে কংসের পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন, নিজে রাজা হয়ে বসেননি। অত্যাচারী কংসের হাত থেকে মথুরাবাসীকে রক্ষা করতে, উগ্রসেনের সিংহাসন তাঁকে ফিরিয়ে দিতে কৃষ্ণ কংসকে হত্যা করেন। এই হত্যা ধর্মপ্রতিষ্ঠার জন্য, ন্যায়প্রতিষ্ঠার জন্য—আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নয়, নিজে সিংহাসনে বসার জন্য নয়। কংস-নিধনের পর কৃষ্ণ বিলাপ করেছিলেন, দুঃখ পেয়েছিলেন। কৃষ্ণ সেই মহামানব, যিনি লোকশিক্ষার্থে কর্ম করেন, ধর্মের পথ ধরে কষ্ট সহ্য করে এগিয়ে চলেন। প্রাবন্ধিকের ভাষায়—“কৃষ্ণ পরম বলশালী, পরম কার্য্যাদক্ষ [যৎ], পরম ন্যায়পর, পরম ধর্ম্মাত্মা, পরহিতে রত এবং পরের জন্য কাতর।… তিনি আদর্শ মানুষ।”৪
এই আদর্শ মনুষ্যত্বের চেহারাই প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অঙ্কন করতে চেয়েছেন। মানুষ হিসাবে মনুষ্যজীবনের যাবতীয় বাধাকে অতিক্রম করে কীভাবে একটা মানুষ তিলে তিলে নিজেকে নির্মাণ করে তোলে, কীভাবে সে সম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলে—তারই বৃত্তান্ত ‘কৃষ্ণচরিত্র’ প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে। নিন্দা, লোকাপবাদ, পরাজয়, দু-পা পিছু হটে আসা—এর সবই কৃষ্ণজীবনে ঘটেছে, যা ঘটে আমাদের দৈনন্দিনতায় ক্লিষ্ট জীবনে। কিন্তু এরপরেও অব্যাহত রাখতে হয় এগিয়ে চলা, অবিচল রাখতে হয় নিজেকে, অক্ষুণ্ণ রাখতে হয় কর্তব্যসাধন। এই শিক্ষাই ‘কৃষ্ণচরিত্র’ আমাদের দিতে চায়।
“তোমার প্রেমে ধন্য কর যারে
সত্য ক’রে পায় সে আপনারে।।
দুঃখে শোকে নিন্দা-পরিবাদে
চিত্ত তার ডোবে না অবসাদে,
টুটে না বল সংসারের ভারে।।”৫
মনুষ্যত্বের এই আদর্শ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর জীবনে সার্থক করে তুলেছিলেন। সেই কঠিন ব্রত সম্ভব হয়ে উঠেছিল দেবতা বলে নয়, মানুষ বলে। এইখানেই তাঁর কৃতিত্ব। এখানেই তিনি আলোচনার যোগ্য। যদি দেবতার বলে বলীয়ান হয়ে এই কঠিন মনুষ্যত্বের ব্রত তিনি সম্ভব করে তুলতেন তাহলে আলোচনার কিছু থাকত না। সবই হতো করুণাময়ের লীলাখেলা। শ্রদ্ধেয় প্রাবন্ধিকের আলোচনার বিষয় যে-কৃষ্ণ তিনি ‘মানুষ’, ‘দুঃখে শোকে নিন্দা পরিবাদে’ যিনি আর পাঁচটা মানুষের মতোই আহত হন, বিমর্ষ হন, ব্যথাতুর হন।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক—বঙ্কিমচন্দ্র কি অস্বীকার করতে চাইছেন কৃষ্ণের দৈবীসত্তাকে? অস্বীকার করতে চাইছেন, তিনিই সেই পরমসত্তা, যিনি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর? অর্জুনের সংশয় জাগলে যিনি বিশ্বরূপ দেখিয়ে নিঃসংশয় করেছিলেন তাঁকে? যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক এখানে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছেন আমাদের। কৃষ্ণ দেবতা কী অবতার, নাকি স্বয়ং ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ামক হয়েও নরদেহ ধারণ করেছেন—এই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দায় তিনি সরাসরি চাপিয়ে দিয়েছেন পাঠকেরই ওপরে। তিনি বলেছেন—কৃষ্ণ স্বয়ং দেবতা কি না সেই বিচারে তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই। দেবতা হলেও তিনি যখন মানুষ, তখন তিনি ‘মানুষ’ই। মনুষ্যত্বই তাঁর পরিচয়। পৃথিবীর রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ সবই তাঁকে স্পর্শ করে। পৃথিবীর সাধারণ মানুষের মতোই আর পাঁচটা বিষয় তাঁকে হাসায়, কাঁদায়, দোলায়িত করে। তার পরেও তিনি নরশ্রেষ্ঠ, এখানেই তাঁর পরিচয়! “তিনি ঈশ্বর কি না, তাহা আমি কিছু বলিতেছি না, সে কথার সঙ্গে পাঠকের কোনো সম্বন্ধ নাই। কেন না, আমার যদি সেই মত হয়, তবু আমি পাঠককে সে মত গ্রহণ করিতে বলিতেছি না। গ্রহণ করা না করা, পাঠকের নিজের বুদ্ধির ও চিত্তের উপরে নির্ভর করে, অনুরোধ চলে না।”৬
মানবিক রূপের মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে কৃষ্ণের যাবতীয় শিক্ষণীয় আচরণের তাৎপর্য। ধর্মরক্ষার্থে তৎপর হওয়াতেই মানুষের পরিচয়, কৃষ্ণের পরিচয়। ছদ্মবেশী সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণের বেশধারী তিন অতিথির অন্যতম তিনি। কৃষ্ণকে জরাসন্ধ ব্রাহ্মণ ভেবে পূজা নিবেদন করেছিলেন। কৃষ্ণ সে-পূজা গ্রহণ না করাতে বিস্মিত জরাসন্ধ এরূপ আচরণের কারণ জিজ্ঞাসা করেন। কৃষ্ণ জানান—শত্রুর পূজা গ্রহণ করতে তিনি অপারগ। জরাসন্ধ আরো বিস্মিত হয়ে বিনা কারণে তাঁকে শত্রু ভাবার কারণ জিজ্ঞাসা করলে কৃষ্ণ জানান—কোনো ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতির কারণে এই শত্রুতা নয়, যিনি দশের ক্ষতি করেন তিনিই তাঁর শত্রু। কৌরবপক্ষ অবলম্বন করে জরাসন্ধ অধর্মের পক্ষ অবলম্বন করেছেন, তাই তিনি তাঁর শত্রু।
এইখানে কৃষ্ণ আরো একটি শিক্ষার দিকে আমাদের এগিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানকালে, যে আমাদের ক্ষতি করছে সে-ই কেবল শত্রু বলে পরিগণিত হয়। কিন্তু ধর্মরক্ষার্থে, দশজনের পক্ষে যে ক্ষতিকারক তারই শত্রুরূপে চিহ্নিত হওয়া উচিত। প্রকৃত মানুষ যিনি তিনি নিজের দিকে তাকিয়ে চলবেন না, সকলের দিকে তাকিয়ে চলবেন। সকলের কল্যাণই ধর্ম। সকলের অকল্যাণই অধর্ম। “আমি তো কোনো পাপ করিতেছি না, পরে করিতেছে, আমার তাতে দোষ কি? যিনি এইরূপ মনে করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকেন, তিনিও পাপী।”৭
এখান থেকে কৃষ্ণের চরিত্র আরো একদিক থেকে তাৎপর্যবান হয়ে ওঠে। জগতে ধর্মরক্ষার জন্য যে-মহাপুরুষেরা অবতীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা অনেকেই অহিংসার কথা বলেছেন, প্রেমের কথা বলেছেন। বুদ্ধ, খ্রিস্ট—এঁরা কেউই অস্ত্রধারণ করেননি। কিন্তু কৃষ্ণ ধর্মরক্ষার্থে অস্ত্রও হাতে তুলে নিয়েছেন। এর কারণ, তিনি অন্যদের মতো ধর্মপ্রচারকেই একমাত্র উদ্দেশ্য হিসাবে গ্রহণ করেননি। একজন আদর্শ পুরুষের বহুমুখী জীবনযাপনের অন্যতম দিক হলো ধর্মপ্রচার। কৃষ্ণ একজন সর্বাঙ্গীণ সফলতাযুক্ত মানুষ। আদর্শ পুরুষ। প্রেম, করুণা, বীরত্ব, সংযম, সংগ্রাম—সব দিকের আচরণেই তিনি পরিপূর্ণ। তাই তিনিই আদর্শ পুরুষ, মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ।
এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্ম্মতত্ত্ব গ্রন্থের উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে। সেখানে তিনি বলেছেন—‘সর্বগুণযুক্ত, সর্বসুখসম্পন্ন মনুষ্য’ই প্রকৃত মানুষ, মনুষ্যত্বের পরাকাষ্ঠা। হিন্দুধর্মে এই সর্বগুণসম্পন্ন মানুষকেই আদর্শ পুরুষ বলা হয়েেছ। সেই হিসাবে রামচন্দ্র সেই আদর্শ পুরুষের অন্যতম। তিনি একইসঙ্গে করুণাহৃদয়, দয়াশীল, পরদুঃখে কাতর, যথার্থ প্রেমিক, যথার্থ স্বামী, প্রজাহিতকারী রাজা, আবার প্রকৃত যোদ্ধা। কৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ। তাঁর চরিত্রে বিন্দুমাত্র অপূর্ণতা নেই, দোষ নেই। তাই তিনি ‘আদর্শ’—পৌরুষের আদর্শ। এই আদর্শ হিন্দুর জাতীয় আদর্শ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই আদর্শকেই জনসমক্ষে তুলে ধরতে চেয়েছেন, বাঙালির আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন।
সমগ্র আলোচনার নিরিখে কৃষ্ণকে এক সর্বগুণসম্পন্ন মানুষ হিসাবেই আমরা পেলাম—শৈশবে, কৈশোরে যিনি বলশালী, দুরন্ত, নেতৃত্বদানের অধিকারী অথচ দুর্বুদ্ধিপরায়ণ নন, পরহিতকারী, বন্ধুবৎসল। যৌবনে তিনি প্রেমিক—যথার্থ প্রেমিক। শত্রুর কাছে তিনি নির্মম। তাঁর কাছে সে-ই শত্রু, যে সাধারণ মানুষের অকল্যাণে নিয়োজিত। তিনি শুধু বীর নন, রণপটু অর্থাৎ বিচক্ষণতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ফলত অপরাজেয়। ক্ষত্রিয় সমাজের কাছে তিনি সমকালের সর্বপ্রধান অস্ত্রবিদ বলে পরিচিত। জ্ঞানার্জনী বৃত্তির প্রকাশে তিনি চূড়ান্ত সফল। কারণ, তিনি অদ্বিতীয় বেদজ্ঞ। তাঁর প্রচারিত তত্ত্ব তার প্রমাণ দেয়। রাজনীতিতেও তিনি দক্ষ। এও তাঁর জ্ঞানার্জনী বৃত্তির অন্যতম প্রকাশ। বুদ্ধি তাঁর সর্বব্যাপী, সর্বদর্শী। মানুষের শরীর ধারণ করে জ্ঞানকে যতদূর সম্ভব মেলে ধরা যায়, তিনি তা করেছেন। শুধু তাই নয়, কার্যকারিণী বৃত্তিও তাঁর চরমভাবে সফল। তাঁর সাহস, ক্ষিপ্রতা, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্যতা—এসবই কার্যকারিণী বৃত্তির চরম প্রকাশের পরিচায়ক। তার পাশাপাশি চিত্তরঞ্জিনী বৃত্তির প্রকাশেও তিনি শ্রেষ্ঠতম। বৃন্দাবনের ব্রজলীলায় তার পূর্ণতম প্রকাশ। পরবর্তিকালে সমুদ্রবিহার, যমুনাবিহার ইত্যাদি প্রসঙ্গেও তার প্রমাণ আমরা বারে বারে পেয়েছি। এককথায়, মানুষ হিসাবে যতগুলি বিষয়ে উৎকর্ষসাধন সম্ভব, কৃষ্ণ তা করে দেখিয়েছেন। তাই মানুষ হিসাবে তিনি আদর্শ—শ্রেষ্ঠতম।
ভক্তি মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠতম পথ। কৃষ্ণের জীবনে সেই ভক্তির প্রকাশও ঘটেছে অন্য পথে। তাঁর ভক্তির লক্ষ্য তিনিই। নিজেকে উপলক্ষ করেই তাঁর ভক্তির স্রোতোধারা উৎসারিত। ছান্দোগ্যোপনিষদে এই ভক্তির কথা আছে, এর নাম ‘আত্মরতি’। আত্মাতেই তার আনন্দ, আত্মাতেই তার ঈশ্বরদর্শন—কৃষ্ণ সেই পথের পথিক। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—আপনাকে এক অফুরান জানা। “এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।” এই জানায় ‘তুমি’ ‘আমি’ একাকার হয়ে যায়। হয়তো বা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সেই অসামান্য নুনের পুতুলের সাগরে নুন মাপতে যাওয়ার উদাহরণের উপলব্ধি—ঠিক ততটা নয়। কেননা অহংবোধ তখনো তাঁর আছে। কিন্তু চেতনায় কোথাও নিজেকে সেই পরিপূর্ণ বলে চিনতে পারা। ‘সো অহম্’। সেইখানে আত্মরতি কোথাও ‘তুমি’ ‘আমি’কে এক করে মিলিয়ে দেয়।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক—একই মানুষের পক্ষে এই সর্বগুণসম্পন্ন হয়ে ওঠা কি সম্ভব? পরিপূর্ণতার, উৎকর্ষের এমন চরম উদাহরণ কোনো কালে কি কোনো মানুষের মধ্যে দেখা গিয়েছে? মানুষ তো দোষে-গুণে ভরা। তার ওপরে দৈনন্দিনতার নিদারুণ তুচ্ছতা, গ্লানি তো প্রতি মুহূর্তে আহত করছে আমাদের; ভেঙে দিচ্ছে আমাদের যাবতীয় সম্ভাবনাকে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে। এই সময়ে দঁাড়িয়ে কীভাবে সম্ভব এই সার্বিক পরিপূর্ণতার উদাহরণকে অনুসরণ করা? আর যদি নাই সম্ভব তা, তাহলে এর আলোচনারই কী বা প্রয়োজন?
প্রয়োজন সেইখানে আরো বেশি করে সত্য হয়ে ওঠে। ভাঙন এত প্রবল বলেই জাগরণের প্রয়োজন এত বেশি। সর্বাঙ্গীণ পরিপূর্ণ সফলতা মানুষের জীবনে হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু সেই পূর্ণতার জন্য যাত্রা তো সম্ভব। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য যে-যাত্রা, সেই তো অর্থ দেয় জীবনকে। ‘জগৎ’ শব্দের মূলে আছে সেই যাত্রার ব্যঞ্জনা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন : “যেমন ভাব তেমনই লাভ।” যতখানি দেব এই জীবনকে, ততখানিই তো ফিরে পাব আমরা। ‘কৃপণ’ কবিতার সেই ভিখারিটি তার ঝুলি থেকে একটি ছোট শস্যকণা দিয়েছিল তুলে। সেই একটি কণাই ফিরে এসেছিল সোনা হয়ে তার ভিক্ষার ঝুলিতে। কৃষ্ণ তাঁর জীবনাচরণ থেকে যে পরিপূর্ণ সার্থকতার সাধনা আমাদের উপহার দিয়ে গিয়েছেন, তার যতটুকু গ্রহণ করা যায় ততটুকুই লাভ। জাতির কাছে এই বার্তাই তুলে ধরতে চেয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্র। অসম্ভবের আত্মপ্রবঞ্চনা আমাদের কিছুই দিতে পারে না, কিছুই দেয়নি এতকাল। স্বাধীনতার জন্য সেদিন জাতির প্রয়োজন ছিল এক উন্নত বলিষ্ঠ আদর্শের। প্রয়োজন ছিল তেমনই এক আদর্শযুক্ত মানুষের উদাহরণের। কৃষ্ণ সেই উদাহরণ। মনুষ্যত্ব থেকে দেবত্বের দিকে তাঁর যাত্রা—ক্লান্তিহীন যাত্রা। সেই যাত্রাই তাঁকে দেবত্বের পরিচয়ে চিহ্নিত করেছে। বাঙালি তথা ভারতবাসীর কাছে পরাধীনতার দিনগুলিতে এই উদাহরণের প্রয়োজন সেদিন যেমন ছিল, আজও তেমনই রয়ে গিয়েছে। কেননা ভয়শূন্য চিত্তের সেই স্বাধীনতা আজও অধরা। আমরা জানি না, সভ্যতাকে আরো কতকাল অপেক্ষা করতে হবে এর জন্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ তাই আজ আরো বেশি করে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।
তথ্যসূত্র
১ সুবোধ চক্রবর্তী (সম্পাদিত), বঙ্কিম রচনাবলী, কামিনী প্রকাশালয়, কলকাতা, ১৯৯১, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২৭২
২ বঙ্কিম রচনাবলী, ‘কৃষ্ণচরিত্র’, পৃঃ ৪৫০
৩ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ৪।১১
৪ বঙ্কিম রচনাবলী, ‘কৃষ্ণচরিত্র’, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৪৭৮
৫ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গীতবিতান, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ১৪০৬, পৃঃ ৪১
৬ বঙ্কিম রচনাবলী, ‘কৃষ্ণচরিত্র’, পৃঃ ৫০৬
৭ ঐ, পৃঃ ৫১৪