স্বামী বিবেকানন্দের ‘পত্রাবলী’ আজও তাঁর রচনা-সংকলনের মধ্যে এক অনবদ্য অনুপম সৃষ্টি। তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছেন, বিদেশযাত্রা করেছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁর গুরুভাইদের চিঠি লিখেছেন। সেইসব চিঠির মর্মকথা আজও আমাদের চলার অন্যতম পাথেয়। অথচ সেদিন এই চিঠিপত্র নিয়েই ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল। সেকথা আমরা হয়তো অনেকে জানি না। ১৯১৫ সালে স্বামীজী দেহ রাখার পরেও যখন তাঁর পত্রাবলীর বিভিন্ন খণ্ড প্রকাশিত হচ্ছে তখন সেই পত্রাবলী কেন এত জনপ্রিয় হচ্ছে, কেন এত সংস্করণ হচ্ছে, এই চিঠিগুলোতে কী এমন আছে যার জন্য সে-সময়কার যুবসমাজ উদ্বেলিত-আন্দোলিত—সেইসময় এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য ব্রিটিশ গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে উঠেছিলেন।
আজও মহাফেজখানায় রক্ষিত ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের সেই রিপোর্টগুলি অনুসরণ করলে দেখা যায়, সামান্য একটি পত্রাবলীর সংস্করণ নিয়ে একজন গোয়েন্দা থেকে আরেকজন গোয়েন্দা, একজন পুলিশ অফিসার থেকে আরেকজন পুলিশ অফিসারের মধ্যে কত চিঠিচাপাটির আদান-প্রদান হচ্ছে! একটা ছোট্ট উদাহরণ দিচ্ছি—১৯১৫ সালের ২৬ মে, ব্রিটিশ গোয়েন্দা ফাইলের DO No. 22-C। বেঙ্গল লাইব্রেরির কাছে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা ‘কনফিডেনসিয়াল’ লেখা নোট পাঠাচ্ছেন। বলছেন—আমাদের বিবেকানন্দের প্রকাশিত পত্রাবলীর খুব প্রয়োজন। তার ইংরেজি অনুবাদ এবং বাংলা—সবই চাই। অবিলম্বে সেগুলো আমাদের কাছে হস্তান্তরিত করা হোক। কোথায় কী অতিরিক্ত লেখা হচ্ছে, কোথায় কী বাদ যাচ্ছে, কোন চিঠিতে তিনি কী লিখেছেন—এই সবই তখন গোয়েন্দাদের তদন্তের বিষয়। ভাবলে কিন্তু অবাক হতে হয়।
১৯১৫ সালের ১৭ মে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ CID-র স্পেশাল অ্যাসিস্টেন্ট বেঙ্গল লাইব্রেরির প্রধান লাইব্রেরিয়ান একটা চিঠিতে লিখছেন—আপনার গোয়েন্দা রিপোর্ট 6438—616-15IB, তাতে পত্রাবলী বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ যেটি প্রকাশিত হয়েছে তার কপি আপনারা চেয়েছেন এবং সেব্যাপারে আমাদের বক্তব্য জানতে চেয়েছেন। এই বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ১০৮-১০৯। আর তৃতীয় সংস্করণটা এখনো আমাদের বেঙ্গল লাইব্রেরিতে এসে পৌঁছায়নি। চতুর্থ সংস্করণ অবশ্য ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
সেইসময় এই বইগুলি পড়ে নাকি বাংলা তথা ভারতীয় যুবসমাজের একটা বড় অংশ মহারাষ্ট্র এবং মাদ্রাজে স্বাধীনতা সংগ্রামের মন্ত্রে দীক্ষিত হচ্ছে। এসমস্ত চিঠি পড়ে তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি পাচ্ছে। কাজেই, রামকৃষ্ণ মিশন কি আসলে এই ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত আছে? এই প্রশ্নটা কিন্তু বারবার এসেছে এসমস্ত কনফিডেনসিয়াল নোট থেকে। এসমস্ত নথির অনেকটাই প্রকাশিত হয়েছে রাজ্য মহাফেজখানার তৎকালীন প্রধান, ঐতিহাসিক লাডলিমোহন রায়চৌধুরির হাত ধরে। এই ধরনের ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্টের প্রায় অনেকটাই তিনি প্রকাশ করেন এবং সেগুলি বাংলায় অনুবাদ করেন। এছাড়া বই হিসাবেও পরে তা প্রকাশিত হয়।
প্রয়াত গবেষক অধ্যাপক ডক্টর শঙ্করীপ্রসাদ বসু বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ বইতে লাডলিমোহন রায়চৌধুরীই যে প্রথম মহাফেজখানা থেকে এই ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রকাশ করেন তা স্বীকার করে তিনিও তাঁর মতো করে বেশ কিছু ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সেখান থেকে আজও আমরা এবিষয়ে অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে পারি।
ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর যখন অতিক্রান্ত হচ্ছে সেইসময় মনে হলো, একবার যদি এই মহাফেজখানায় গিয়ে নিজের চোখে এই রিপোর্টগুলো দেখি তাহলে একজন গৃহিভক্ত এবং সাংবাদিকের প্রেক্ষিতে নতুন কিছু তথ্য পেতে পারি অথবা পুরানো তথ্যকে আবার নতুন করে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। আজ ২০২২-এ দাঁড়িয়ে যদি তার প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবনের চেষ্টা করি তাহলে মন্দ হয় না। এই বিষয়ে গবেষণা করার পরামর্শটি দিয়েছিলেন ‘উদ্বোধন’ পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক। তার ভিত্তিতে গত কয়েক মাস ধরে একজন ছাত্র-গবেষক হিসাবে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি বারবার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য মহাফেজখানায় গিয়ে এই তথ্যগুলোকে নতুন করে জানার।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা উচিত, এই মহাফেজখানার জন্ম হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। তখন সিপাহী বিদ্রোহ হচ্ছে। এই মহাফেজখানার জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের নিজের স্বার্থে, নিজের পুলিশ এবং গোয়েন্দা কার্যকলাপকে সুষ্ঠুভাবে পালন করার জন্য, যা সেইসময় ভারতের স্বার্থবিরোধী ছিল। তবে এই ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই যে, সেই ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশের যে গবেষণা এবং ইতিহাসচেতনা তা ঈর্ষণীয় ছিল।
এই মহাফেজখানার প্রথম যাত্রাপথ শুরু হয়েছিল কলেজ স্ট্রিটের বাড়িতে। সেই বাড়িটি এখনো রয়েছে। সেখানে এখনো রাশি রাশি ফাইল রয়েছে। আর তার পাশাপাশি শেক্সপিয়ার সরণিতেও আছে রাজ্য মহাফেজখানার বিশাল অট্টালিকা।
যে পত্রাবলী আজ বহুল প্রচারিত এবং রামকৃষ্ণ-ভক্ত গবেষকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটি গ্রন্থ, সেটি নিয়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের এত কেন তৎপরতা ছিল, সেকথা যদি বুঝতে হয় তাহলে আমাদের এই ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্টের আরেকটি অংশে পৌঁছাতে হবে। একটি কনফিডেনসিয়াল রিপোর্ট পাবলিক ইন্সট্রাকশন ডিপার্টমেন্ট ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগের—ফর্ম নাম্বার ২৬-A; সেটিও ১৯১৫ সালের ২৯ এপ্রিল স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্টকে পাঠানো হচ্ছে, যিনি ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ। এই সমস্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন্স, যিনি বাংলার ডিরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন W. C. Worseworth, তাঁর কাছে গোয়েন্দাদের যে-রিপোর্টটা দেওয়া হয়েছে তাতে পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগ থেকে গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন : “I have the honour to forward here with a copy of letter No 11C dated the 6th April, 1915 with enclosure from the Librarian Bengal Library for such action as may be deemed necessary. Your most obedient Servant W C Worseworth director of Public Instruction 29th April, 1915.”
সুতরাং, পাবলিক ইন্সট্রাকশন বিভাগের অধিকর্তার মনে হয়েছে, এটা পবিত্র গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য, তাই এই ব্যাপারে সমস্ত বইটির শুধু কপি জোগাড় করা নয়, সম্পূর্ণ তথ্যগুলো পর্যন্ত তিনি সঠিকভাবে সংগ্রহ করেন। এছাড়া ১৯ মার্চ ১৯১৫ এই বইটা সম্পর্কে গোয়েন্দা রিপোর্টে প্রশ্ন তোলা হয়েছে—এই বইটির মুদ্রক কে ছিলেন? প্রকাশক কে ছিলেন? এই বইটির প্রকৃত টাইটেলটা কী? কোন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল? এই বইটির বিষয়বস্তুকে এককথায় কী বলা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে, যেগুলো এখন কার্যত বইটিতেই ছাপা থাকে, সেইগুলো কষ্ট করে সেইসময় গোয়েন্দাদের জানতে হচ্ছে। কেননা, বইটি প্রকাশের আগেই গোয়েন্দারা সেই তথ্যগুলো জানতে চাইছে। যাদেরকে এখন আমরা ‘মোল’ বলি, তারা রামকৃষ্ণ মিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঢুকে পড়ে ভক্তদের মাঝখানে গিয়ে নানান রকম আলাপ-আলোচনা করে বিভিন্ন তথ্য জানার চেষ্টা করছে। এখন অবশ্য সেসব ভাবলে ব্যাপারটা খুব হাস্যকর বলে মনে হয়। তবে সেদিন কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে এসব ছিল বিরাট গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়।
রিপোর্টে লেখা হয়েছে, ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের বড়কর্তাদের গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, যারা ফিল্ড রিপোর্টিং করে তারা রিপোর্ট দিচ্ছে—মুদ্রক এবং প্রকাশক হচ্ছেন কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষ। টাইটেল এবং ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে পত্রাবলীর। অর্থাৎ, Letters of Swamiji। ভাষা হচ্ছে মূলত বাংলা। ইংরেজিতে সেটার অনুবাদ হচ্ছে। বিষয়বস্তুটাকে বলা হয়েছে কিন্তু ধর্মীয়। প্লেস অব প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন—৬৮-সি, বলরাম দে স্ট্রিট, কলকাতা। প্রিন্টার্স পাবলিশার্স বলা হয়েছে—কে. সি. ঘোষ, ১ নম্বর মুখার্জি লেন। ডেট অব ইসু—২৫ ফেব্রুয়ারি। এই বইটিতে মোট ১২৫টি পৃষ্ঠা আছে। বইয়ের আকার D-crown, 16MO. নাম্বার অব এডিশন—৪টে। কতগুলো কপি ছাপা হয়েছে? ২০০০ কপি। Lithographed বাংলায়। দাম আট টাকা। প্রোপাইটারের নাম ঠিকানা কী এবং কপিরাইট কার?—স্বামী ব্রহ্মানন্দ। তিনি তখন রামকৃষ্ণ মিশনের প্রেসিডেন্ট বা অধ্যক্ষ। ১৯১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হলো সেই বই—যে-বইটি প্রকাশের আগে থাকতে গোয়েন্দারা তদন্ত শুরু করেন এবং বইটি প্রকাশের পর তাঁরা লাইব্রেরির কাছ থেকে দ্রুত তার কপি চেয়ে সেগুলো বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু কেন?
আসলে, আজ আমরা বসবাস করছি কমিউনিকেশনের যুগে—যে-যুগে ইন্টারনেট প্রযুক্তি, সোস্যাল মিডিয়া কোথায় পৌঁছে গেছে! এই আখ্যানের শুরু করলাম ১৯১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি—যখন প্রকাশিত হচ্ছে স্বামী বিবেকানন্দের পত্রাবলীর বিশেষ সংস্করণ। তবে এই আখ্যানের ইতিহাস আরো অনেক প্রাচীন—যখন স্বামীজী শিকাগো-বক্তৃতা দিয়ে দেশে ফিরেছেন। সে ছিল এক ভারতীয় সন্ন্যাসীর বিশ্ববিজয়। সেইসময় তাঁকে নিয়ে কলকাতায় শোরগোল পড়ে গেছে। তাঁকে ঘিরে তখন নানারকম আলাপ-আলোচনা, সভা-সমাবেশ হচ্ছে। যখন রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে এবং এরপর যখন স্বামীজী বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠা করছেন—সেইসময় অর্থাৎ স্বামীজী বেঁচে থাকাকালীনই ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠেছিল যে, বেলুড় মঠ কি তবে চরমপন্থী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আশ্রয়স্থল? মেন্টর? বেলুড় মঠ কি তাহলে জঙ্গি স্বাধীনতা সংগ্রামের গোপন স্নায়ুকেন্দ্র?
স্বামী বিবেকানন্দের অধ্যাত্মদর্শনের সঙ্গে সামাজিক সচেতনতা বিশেষভাবে যুক্ত হয়েছিল। ভারতের সনাতন হিন্দুধর্মের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করলেও স্বামীজী তাকে সময়ের সঙ্গে উপযোগী করে এক নয়া বেদান্তের কথা বলেছিলেন—যে-বেদান্ত এক বিশেষ ধরনের মানবতাবাদের কথা বলে, যে-বেদান্ত নরনারায়ণের সেবার কথা বলে। স্বামীজী বললেন : “জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।”১ শুধু তাই নয়, স্বামীজী কিন্তু নিজের সম্পর্কে বলেছেন যে, আমি একজন ‘সমাজতন্ত্রী’। এখানে সমাজতন্ত্র শব্দটাকে যদি কেউ মার্ক্সবাদী সাম্যবাদের সঙ্গে যুক্ত করে অথবা সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের ধাঁচে তার পূর্বাভাসের কথা ভাবেন, তাহলে ভুল হবে। এখানে তিনি সমাজতন্ত্রকে এক বৈদান্তিক সাম্যবাদের প্রেক্ষিতে দেখেছেন।
স্বামীজী শিকাগো থেকে ফিরেছেন ১৮৯৭ সালে, আর সেইসময় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের রাজনৈতিক পটভূমিতে সাংঘাতিকভাবে এক শোষণ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নরম পন্থার পাশাপাশি তিলক ন্যাশনালিজমের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, সেইসাথে অনুশীলন সমিতি, যুগান্তরও কিন্তু বিকশিত হচ্ছে। ঋষি অরবিন্দের চরমপন্থী রাজনৈতিক দর্শন, তার সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের যোগাযোগ কতটা সেটা নিয়েও কিন্তু ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের তদন্তের সীমা-পরিসীমা ছিল না! এমনকী স্বামীজীর ভাবাদর্শকে হাতিয়ার করে সিস্টার নিবেদিতা যখন প্লেগের দুর্যোগে মানুষের সেবা করেছেন তখন স্বামীজী, নিবেদিতা, অরবিন্দ তথা আরো বহু তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিেত্বর ওপর ব্রিটিশ নজরদারি সাংঘাতিক। এসব কথা অতীতে বারবার আলোচিত হয়েছে। লাডলিমোহন রায়চৌধুরী থেকে শঙ্করীপ্রসাদ বসু বহুবার এবিষয়ে আলোচনা করেছেন। স্বামী পূর্ণাত্মানন্দকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ। সেখানে তিনি জানিয়েছেন কীভাবে স্বামীজীর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে জাতীয়তাবাদী পথে এগিয়েছেন। আজ এত বছর পর ব্রিটিশদের গোয়েন্দা রিপোর্ট দেখে এটা বুঝতে পেরেছি যে, সেইসময় ব্রিটিশ গোয়েন্দারা প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন। কেননা, আজ এই কমিউনিকেশনের যুগে, সোস্যাল মিডিয়ার যুগে সেই সময়কার যে দুর্বল কমিউনিকেশন, তার সঙ্গে তো তুলনা করা যায় না। তখন চিঠিপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। তৎকালীন বিদ্বৎসমাজে চিঠিপত্রের চল ভীষণভাবে ছিল। কেননা, সেইসময় ডাকব্যবস্থাটাই ছিল সবথেকে বড় যোগাযোগের মাধ্যম। ব্রিটিশ যুগে একদিকে যেরকম রেল মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বাড়িয়েছিল, সেরকমভাবে ডাক ও তার ব্যবস্থা মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগকে অনেক বেশি বাড়াতে সাহায্য করেছে। এইসময় স্বামীজীর বাণী এবং তাঁর চিঠিপত্র যে মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিল, সেব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ নেই। তবে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে রামকৃষ্ণ মিশন কতটা জড়িয়েছিল তার সাক্ষ্য প্রমাণ খোঁজার জন্য ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের তৎপরতা কী সাংঘাতিক ছিল, সেটা কিন্তু এখনো এই মহাফেজখানাতে এলে বোঝা যায়।
গোয়েন্দাদের এসমস্ত রিপোর্টের অন্তত দশটি ফাইল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে পাচ্ছি, ব্রিটিশ গোয়েন্দারা কিন্তু কোথাও প্রমাণ করতে পারছেন না যে, সরাসরিভাবে রামকৃষ্ণ মিশন এই চরমপন্থী স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। রিপোর্টে দেখতে পাচ্ছি, অভিযোগ এসেছে যে, স্বামী অভেদানন্দজী যখন আমেরিকা থেকে ভারতে আসছেন, তখন তিনি নাকি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেবেন বলে সেই দেশ থেকে বন্দুক বা আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে নিয়ে আসছেন!
স্বামীজীর ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত যখন জার্মানিতে ছিলেন, তখন তাঁর পিছনে পর্যন্ত টিকটিকি লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসমস্ত তথ্য—যেগুলো প্রমাণিত হয়নি, সেগুলোকে ইন্টেলিজেন্সের ভাষায় বলা হয় ‘লিড’। গোয়েন্দারা বিভিন্ন সময়ে নানান রকমের ‘সোর্স’ কাজে লাগিয়ে এধরনের কিছু ‘লিড’ দিয়েছেন—যেগুলোর ভিত্তিতে একের পর এক গোয়েন্দা, সিনিয়র গোয়েন্দা এবং তারও সিনিয়র গোয়েন্দারা তদন্ত চালিয়েছেন। শেষপর্যন্ত অবশ্য কিছুই হয়নি। তবে এটা মানতেই হবে, ব্রিটিশ গোয়েন্দারা লিখিতভাবে রিপোর্ট জমা দিয়ে বলেছেন যে, এসমস্ত অভিযোগ এসেছিল। গোয়েন্দারা এটাও স্বীকার করেছেন, তাঁরা বেশ কিছু লোককে তাঁদের ‘মোল’ হিসাবে রেখেছিলেন—যাদেরকে তাঁরা পারিশ্রমিক দিতেন। শুধু বেলুড়ে নয়, চেন্নাইয়ে, বরিশালে, ঢাকার বিভিন্ন রামকৃষ্ণ মিশনের সংগঠন, ক্লাব এবং শিক্ষালয়ে গিয়ে তাঁরা খোঁজখবর করে সেইসব ভারতীয় ভাড়াটের সূত্রে জানতে পেরেছেন—যারা ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের রিপোর্ট দিয়েছে। তার ফলে তাঁরা নানারকমের কিছু রোমহর্ষক কাহিনি জানিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তিকালে দেখা গেছে, সেগুলো প্রমাণিত হচ্ছে না। তখন সেই ব্রিটিশ গোয়েন্দা পুলিশের ডি.আই.জি কিংবা তাঁদের কলকাতার সদর গোয়েন্দা দপ্তরের প্রধান জানিয়ে দিচ্ছেন, এরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না যাতে করে বলা যায় যে, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন সরাসরিভাবে বিপ্লবী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত। তবে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে তারা কীভাবে উদ্বুদ্ধ হয়েছে সেটা কিন্তু গোয়েন্দারা বিভিন্ন রিপোর্টে দিয়েছেন। আসুন, আমরা এই তফাতটা অর্থাৎ প্রত্যক্ষ মদত দেওয়া এবং পরোক্ষভাবে মতাদর্শগতভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামকে উদ্বুদ্ধ করা—এই ব্যাপারে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা কী বলেছেন, কোন রিপোর্টে কীভাবে তাঁরা সেটার ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটারও আমরা যথার্থ বিশ্লেষণ করে দেখি।
বাংলায় বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের যে-চেষ্টা হয়েছিল তার ওপর সিডিশন কমিটি ১৯১৮ সালে একটি বিখ্যাত রিপোর্ট দিয়েছে। আমরা এখন তার উৎস জানতে পেরেছি। বাংলার ক্ষেত্রে F. C. Daily, J. C. Nixon, J. E. Armstrong, L. Enbard এবং H. L. Solkild-এর প্রতিবেদনে বারবার বলা হয়েছে যে, বিপ্লবীদের আখড়াগুলোতে গোয়েন্দারা অনুসন্ধান চালিয়ে সবসময় তিনটি বই পেতেন। তার প্রথম বইটি হলো গীতা, দ্বিতীয় বইটি হলো বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ। আর সবচেয়ে বেশি যে-বইটি জনপ্রিয় হয়েছিল, সেটা স্বামী বিবেকানন্দের বর্তমান ভারত। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠি বলেছেন, স্বামী বিবেকানন্দ কোনো অনুশীলনধর্ম প্রচারী উপন্যাসের নায়ক নন। তিনি ছিলেন ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’, রক্ত-মাংসে গড়া নবীন সন্ন্যাসী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রেরণা। তিনি কবির চোখ দিয়ে দেশকে দেখেননি। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত সমগ্র ভারতবর্ষ তাঁর চোখে দেখা দিয়েছিল কোটি কোটি শূদ্র, মুচি, মুদ্দাফরাস এবং চণ্ডালের রূপ ধরে—নিরন্ন, নিরক্ষর, অপমানিত, অবজ্ঞাত নারী-রূপে।
স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজীকে স্বামীজী চিঠিতে লিখছেন : “দুইই মহাপাপ—মেয়েদের পায়ে দলানো, আর ‘জাতি জাতি’ করে গরীবগুলোকে পিষে ফেলা।”২ নররূপী নারায়ণের পুজো করতে বলে স্বামীজী ‘বর্তমান ভারত’-এর শেষে বললেন : “হে ভারত, ভুলিও না—তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী;… ভুলিও না—নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই! বল—মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই…।”৩ তাহলে বনের বেদান্তকে ঘরে আনার কথাও তিনি বলেছেন।
স্বামীজীর ‘প্র্যাকটিক্যাল বেদান্ত’ শীর্ষক রচনাগুলি সম্পর্কে অমলেশ ত্রিপাঠির মতো ঐতিহাসিকও বলেছেন যে, সেগুলি অবশ্যপাঠ্য। তার কারণ—ধর্ম এখন ভাতের হাঁড়িতে। বীরসন্ন্যাসী স্বামীজী ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলছেন—এই মূর্খতা এবং এই অকর্মণ্যতার বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে। আসলে এই কথাগুলো সেই চিঠিতেও প্রকাশিত হয়েছে, ‘বর্তমান ভারত’-এ প্রকাশিত হয়েছে।
কলকাতার টাউন হল-এ সংবর্ধনাসভার উত্তরে রাজা প্যারিমোহন মুখোপাধ্যায়কে স্বামীজী লিখেছিলেন : “আমার দৃঢ় ধারণা—কোন ব্যক্তি বা জাতি অপর জাতি হইতে নিজেকে সম্পূর্ণ পৃথক রাখিয়া বাঁচিতে পারে না।… আদান-প্রদানই প্রকৃতির নিয়ম…।”৪ আসলে স্বামীজীর এই দর্শনটাই সেইসময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জাতীয়তাবাদী কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে। যতদিন স্বামীজী বেঁচেছিলেন, ততদিন পর্যন্ত গোয়েন্দারা সন্ন্যাসীদের ওপরে এই তদন্তটা চালিয়ে গেছেন। সেইসময় যে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী রামকৃষ্ণ মিশনে সন্ন্যাসী হিসাবে যোগ দিয়েছেন, তার লম্বা তালিকা পাওয়া যায়। আবার অনেকে সন্ন্যাসজীবন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামীর জীবনে যোগ দেওয়ার জন্য রামকৃষ্ণ মিশন ছেড়ে চলেও গেছেন।
এই দেশে জড়বাদী রাজনীতির মতবাদ যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনের যোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল, তেমনি সাধু-সন্ন্যাসীদের অধ্যাত্মচিন্তাও তাঁদের মনে বিপুলভাবে সাড়া জাগিয়েছিল। সেই কারণে ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা ফাইলের পরিভাষায় এঁদের ‘রাজনৈতিক’ সাধু হিসাবে অভিহিত করা হয়। অধ্যাপক ডঃ লাডলিমোহন রায়চৌধুরীর গ্রন্থে ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের গোপন নথি থেকে জানা যায়, সরকারি ফাইলে উল্লেখিত রাজনৈতিক সাধুদের তালিকায় বাংলাদেশের ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সমকালীন সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ভুখা সাধু ও ফকির লুঠেরাদেরও নাম করা হয়েছিল। তাঁরা আসলে সে-অর্থে সন্ন্যাসী ছিলেন না।
রামকৃষ্ণ মঠ এবং মিশনের সহাধ্যক্ষ স্বামী প্রভানন্দজী লিখেছেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এবং বিগত শতাব্দীর গোড়ায় রামকৃষ্ণ মিশন এবং মিশনের প্রাণপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক জাতীয়তাবাদ (Spiritual Nationalism) এদেশের মানুষের মনে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাই বিধর্মী রাজপ্রতিনিধিগণ মিশনের সন্ন্যাসীদের অনেককেই স্বাধীনতা আন্দোলন তথা রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডতে অভিযুক্ত করেছিলেন। সিডিশন কমিটির রিপোর্টে (১৯১৮-এর ২৪ নম্বর অনুচ্ছেদে) বিচারপতি রাওলাট শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে শ্রদ্ধাবনতভাবে উল্লেখ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বিপ্লব আন্দোলন যে বহুলাংশে তাঁদেরই চিন্তাভাবনার ফসল—সেকথাও কিন্তু প্রকারান্তরে ব্যক্ত করেছিলেন : “From much evidence before us it is apparent that this influence was perverted by Barindra and his followers in order to create an atmosphere suitable for the execution of their projects.”
ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্সের এই রিপোর্টগুলোর স্পেশাল ব্রাঞ্চের সারণি থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, বহু অসংগঠিত সন্ন্যাসী সেইসময় স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। এইসব তথ্যের অনেকটা প্রকাশিত হলেও যখন নতুন করে এই ফাইলগুলো আবার দেখতে শুরু করছি তখন একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে যে, স্বামী বিবেকানন্দ এই পরিস্থিতিটা সম্যক অনুভব করে যে-গাইডলাইন দিয়ে যান সেটা হচ্ছে—আধ্যাত্মিক সংগঠন রামকৃষ্ণ মঠ এবং মিশন সরাসরি সক্রিয়ভাবে এই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হবে না। ধর্ম সম্পর্কে প্রাচীন ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে ধর্মকে তার সামাজিক উপযোগিতার দিক থেকে দেখতে হবে। মানুষের অন্তর্নিিহত দেবত্বের বিকাশ যদি ধর্ম হয়, তাহলে শিক্ষা হলো অন্তরস্থিত পূর্ণতার প্রকাশ। শিক্ষা এবং ধর্মকে যুক্ত করে নয়া বেদান্তের পাঠে তিনি একটা সুস্পষ্ট অভিমুখ তৈরি করে দিয়ে গেছেন, যা আজও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন মেনে চলেছে। একারণে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের কোনো যোগ নেই।
আসুন, আমরা এবারে দেখাই, স্বামীজী দেহ রাখার পর স্বামী ব্রহ্মানন্দজী দায়িত্বভার গ্রহণ করার পরেও গোয়েন্দাদের এই তৎপরতা কিন্তু বন্ধ হয়নি। ১৯১১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গোয়েন্দা রিপোর্টের ৫০৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে—স্বামী বিবেকানন্দের ৪৯তম জন্মবার্ষিকী সম্মেলন বেলুড় মঠে পালিত হচ্ছে। সেখানে ১৯১১-র ২৯ জানুয়ারি আরেকটি পৃথক রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে যে, এক পুলিশ অফিসার এই উৎসবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলছেন : বেলুড় মঠে দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে বিকাল সাড়ে চারটে পর্যন্ত এই উৎসব চলে। ৬০০ জন প্রতিনিধি সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ লোকই ছিলেন সমাজের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। এঁরা মূলত কলকাতার হলেও বেশ কিছু ভিক্ষুকও সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। গোয়েন্দাদের রিপোর্টে উল্লেখিত শব্দ হচ্ছে—‘Low class people’। তাঁরাও অনেকে এসেছিলেন। অনেকে আবার ছিলেন অন্য রাজ্যের মানুষ। তাঁদের মধ্যে কুড়িজন মারাঠা এবং মাদ্রাজি মানুষ সেই ভিড়ের মধ্যে মিশেছিলেন। এবার গোয়েন্দারা তাঁদের বেশ কিছু লোককে নিযুক্ত করেন ঐ ভিড়ের মধ্যে উপস্থিত লোকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। বেশ কিছু আমেরিকান এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন যুবাপুরুষ, যাঁর নাম ফ্রান্সিস জন আলেকজান্ডার। ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হচ্ছে, বেশ কিছু সন্দেহজনক চরিত্রকে সেই সম্মেলনে দেখা যায়। তাঁরা সেখানে কেন ছিলেন, কীভাবে ছিলেন এবং এই সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা কারা ছিলেন? তাঁদের নামের একটি তালিকা তৈরি করে ব্রিটিশ গোয়েন্দা প্রধানের কাছে পাঠানো হয়।
রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ঐ সম্মেলনে অন্যতম সন্দেহজনক চরিত্র ছিলেন যোগীন ঠাকুর। তাঁর সঙ্গে আরো ত্রিশজন যুবক ছিলেন। সেই রিপোর্টের অনুচ্ছেদ ২৫৩১ (১৯১১)-তে বলা হচ্ছে—বেশ কিছু বাচ্চা ছেলে ঐ যোগীন ঠাকুরের সঙ্গে ছিল, যারা রান্না করছিল এবং সবাইকে খেতে দিচ্ছিল। এরাই আবার দলবেঁধে গঙ্গাসাগর মেলায় গিয়েছিল। দ্বিতীয় সন্দেহজনক চরিত্র হচ্ছে—ওখানে ‘বিবেকানন্দ সোসাইটি’ নামক একটি সংস্থার বেশ কিছু যুবক স্বামী বিবেকানন্দের একটি ছবি টাঙিয়ে তার সামনে গান গাইছিলেন। তিন নম্বর সন্দেহজনক ব্যক্তিদের তালিকায় যাঁদের রাখা হয়েছে তাঁরা হলেন যথাক্রমে অমৃতলাল গুপ্ত, পূর্ণচন্দ্র কর, পান্নালাল বসাক, কামাখ্যানাথ গুপ্ত, পুলিনবিহারী মুখার্জি। এঁরা সকলেই সেইসময় অনুশীলন সমিতিতে যাতায়াত করতেন। এঁরাই আবার স্বামীজীর জন্মবার্ষিকী সম্মেলনে উপস্থিত থেকেছেন।
অন্য সন্দেহজনক ব্যক্তি কারা ছিলেন? রিপোর্টে বলা হচ্ছে—কানাইলাল ঘোষাল, যিনি সাধুর পোশাকে ছিলেন এবং কাঁধে একটা কম্বল জড়িয়ে রেখেছিলেন। তিনি বেশ কিছু লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে ছিলেন। গোয়েন্দাদের রিপোর্টের ভাষায়—‘কানাইলাল ঘোষাল ইন এ পার্টি’। আরেকজন হলেন নৃপেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী। তিনি ‘যুবকমণ্ডলী’ গঠন করেছিলেন। গরিবদের খেতে দেওয়ার কাজে তিনি খুব সক্রিয় ভূমিকা নেন। আর ছিলেন কৃষ্ণপ্রসাদ ঘোষ। এছাড়া ছিলেন তারাপদ বোস (৪৯১ অনুচ্ছেদ)। তিনি খুলনা থেকে একজন স্বেচ্ছাসেবী সাধুর পোশাকে আসেন এবং নিজেকে স্বামীজীর শিষ্য বলে দাবি করেন। ছিলেন শচীন সেন (প্যারা ৪৩০, ১৯১০)। ছিলেন দেবব্রত বোস। আমেরিকান এক ভদ্রলোকের নাম ছিল মিস্টার আলেকজান্ডার। দেবব্রত বোস তাঁকে ৩০০ মানুষের সামনে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দেন। মিস্টার আলেকজান্ডার তারপরে স্বামীজীর বাণী এবং তাঁর জাতীয়তাবাদী তত্ত্ব মানুষকে বোঝান। আরেকজন ছিলেন তেজনারায়ণ ব্রহ্মচারী। ঠিক হয়, স্বামীজীর দর্শন বোঝাতে তাঁকে আমেরিকায় পাঠানো হবে। তেজনারায়ণ ব্রহ্মচারী স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর শিষ্য। আরেকজনের কথা রয়েছে তিনি শান্তিপুরের বামীন্দ্রনাথ মুখার্জি। তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন নদিয়ার সীয়ারাম ব্রহ্মচারীর কাছে। সীয়ারাম ২৬ বছর বয়সে চলে আসেন। এঁদের প্রত্যেকের সবিস্তার ব্যক্তি-পরিচয়ের রিপোর্ট সেখানে লেখা রয়েছে। আর প্রত্যেকটা রিপোর্টের মাথায় লেখা রয়েছে—‘কনফিডেনসিয়াল’। এই রিপোর্টগুলো লিখেছেন তদানীন্তন বিভাগীয় এস. পি.। স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্ট টু ডেপুটি ইন্সপেক্টর অব পুলিশ মূলত তদন্ত চালাচ্ছেন এবং তিনি রিপোর্ট দিচ্ছেন গোয়েন্দা প্রধানকে।
স্বামী গিরিজানন্দ বেনারসে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে আছেন। তাঁর গায়ের রং কালো। তাঁর খুব ছোটখাট চেহারা। মুখটা গোল কিন্তু ঋজু। তিনি সবসময় একটা গোল টুপি পরে থাকেন। তিনি গেরুয়াবস্ত্র পরিধান করেন না। সম্ভবত মণিপুর থেকে এসেছেন, কিন্তু তিনি অসমের লোক। ঠিক এইরকমভাবে এক-একজন সন্ন্যাসী সম্পর্কে রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে।
১৯১০ সালের ২০ নভেম্বরের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, স্বামীজীর প্রচারে পুরীতে কীভাবে বেশ কিছু সন্ন্যাসী গেছেন সেসব কথা। ইন্সপেক্টরের ইন্সপেকশন রিপোর্ট বলছে, পুরীতে মহারাজ নতুন আশ্রম করতে গেছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন রামানন্দ, নির্মলানন্দ, নির্ভয়ানন্দ এবং হরিদাস ব্রহ্মচারী। মঠের প্রধান হলেন সচ্চিদানন্দ। তাঁর সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হচ্ছে, তিনি অত্যন্ত বৃদ্ধ মানুষ কিন্তু তাঁর মেজাজটা একটু তীক্ষ্ণ। মোট কুড়িজন সাধু তাঁর সঙ্গে পুরীতে থাকেন। স্বামী ব্রহ্মানন্দজী যখন বিভিন্ন জায়গায় মঠ ও মিশন তৈরি করছেন, সাধুদের পাঠাচ্ছেন, তখনো যে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এই তদন্তটা ছাড়েননি—সেসব এইসব রিপোর্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে।
বেনারসে পুরানো আশ্রম। সেখানেও কলকাতা থেকে গোয়েন্দা পাঠানো হয়েছে সেখানে কী কী কাজকর্ম করা হচ্ছে তা দেখার জন্য। আসলে, মানুষের সেবার নাম করে গরিব মানুষদের জাতীয়তাবাদী চেতনা, বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে কি না সেসমস্ত দেখার জন্যই গোয়েন্দাদের পাঠানো হয়েছিল। কখনো ব্যাঙ্গালোরে, কখনো পুরীতে সক্রিয় ছিল গোয়েন্দা পুলিশ।
১৫.৯.১৯০২, বেঙ্গল এস বি ফাইল নম্বর ১০৪৮-এ বলা হচ্ছে—লিফলেট দিয়ে ৫০০ থেকে ৮০০-র বেশি লোককে প্রচার করা হচ্ছে যে, স্বামী অভেদানন্দজী দেশে ফিরছেন। সুতরাং, এই লিফলেটগুলো এতজন মানুষের কাছে প্রচার করা হচ্ছে। হাওড়া স্টেশনে যখন তিনি ট্রেন থেকে নামবেন তখন তাঁরা সেখানে হাজির হবেন। ‘ইন্ডিয়ান মিরর’-এর বাবু নরেন্দ্রনাথ সেন, জ্যোতীন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী, ২৪ পরগনার টাকি থেকে ‘বসুমতী’র জলধর সেন, জ্যোতিষচন্দ্র মিত্তিরের হাওড়া স্টেশনে উপস্থিত থাকার কথা বলে আগাম গোয়েন্দার রিপোর্ট আসছে। জ্যোতিষচন্দ্র মিত্তির স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তদানীন্তন সরকারের ডেপুটি কম্পোট্রোলার হয়েছিলেন। স্বামী অভেদানন্দজীকে যাঁরা অভ্যর্থনা জানাতে স্টেশনে গিয়েছিলেন, তাঁরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যান। একদল লোক ওখানে ‘বন্দে মাতরম্’ স্লোগান দিতে থাকে, যা রাজনৈতিক বিক্ষোভ বলে গণ্য হয়। সেই কারণে বিচারপতি মিত্তির এবং আরো অনেকে অংশগ্রহণ করতে আসেননি। নরেন্দ্রনাথ সেন শেষপর্যন্ত সেখানে যাননি। তার কারণ, ওখানে ‘বন্দে মাতরম্’ স্লোগান দেওয়া হচ্ছিল।
রিপোর্টে বলা হচ্ছে, মিস্টার রবার্ট ওখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ‘স্টেটসম্যান’ কাগজে কাজ করতেন। সেখানে কারা উপস্থিত ছিলেন এবং কারা ছিলেন না—সেসব ব্যাপারে মিস্টার রবার্ট জানান। উল্লেখ রয়েছে যে, স্বামী অভেদানন্দ স্টেশন থেকে নরেন্দ্রনাথ সেনের গৃহে গেলে সেখানে নরেন্দ্রনাথ সেন তাঁকে মাল্যদান করেন।
তবে সমস্ত রিপোর্টের মধ্যে সবচেয়ে সুবিন্যস্ত এবং তথ্যনিষ্ঠ রিপোর্ট প্রস্তুত করেছিলেন চার্লস অগাস্টাস টেগার্ট। তিনি ১৯০১ সালে ভারতীয় পুলিশ বিভাগে যোগ দেন। ত্রিশ বছর ধরে তিনি বাংলার পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৩১ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি ভারত সচিব কর্তৃক ইন্ডিয়ান কাউন্সিলের সদস্য হন। কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাঁকে ‘নাইট-হুড’ খেতাবও দিয়েছিলেন। চাকরিজীবনের শেষ আট বছর তিনি কলকাতার পুলিশ কমিশনার ছিলেন। তিনি খুব বেপরোয়া লোক ছিলেন। তিনি সমস্ত বিপ্লববাদী আন্দোলনের উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তিনি কিন্তু বিপ্লবীদের কাছে বেশ ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন।
রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে টেগার্ট যখন রিপোর্টটা তৈরি করেন, সেইসময় তিনি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের স্পেশাল সুপারিন্টেনডেন্ট ছিলেন। ফুলস্কেপ কাগজে প্রায় ত্রিশ পৃষ্ঠাব্যাপী একটা রিপোর্ট তৈরি করেন। লালরঙের শক্ত মলাটে বাঁধাই করে ১৯১৪ সালের ২২ এপ্রিল তারিখে ‘কনফিডেনসিয়াল’ মার্ক দিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি সেই রিপোর্ট জমা দেন। মলাটের রং ছিল লাল, তাই সরকারি মহলে এটা ‘রেড বুক’ নামে পরিচিত হয়ে যায়। তিনি এই রিপোর্টটার নাম দিয়েছিলেন—‘টেররিজম ইন বেঙ্গল’। তাঁর মত ছিল—ধর্মীয় চরিত্রের সংগঠন হলেও ব্রিটিশ পুলিশ বা ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট রামকৃষ্ণ মিশনকেও রাজনৈতিক কারণে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেননি। আমি দেখছি ফাইলে লেখা আছে—“প্রি ডমিনেন্ট রিলিজিয়াস ক্যারেক্টার অব দ্যা অরগানাইজেশন ডিডনট স্পেয়ার ইট ফ্রম দ্যা স্ক্রুটিনি অব দ্যা ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ।” তাই বাংলাদেশের অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর প্রভৃতি নানান রকমের বিপ্লবী সংগঠনের কাজের ধারা সম্পর্কে খোঁজখবর করতে গিয়ে পুলিশ টের পাচ্ছিল, এইসকল গুপ্ত সমিতির সদস্যদের সঙ্গে মিশনের প্রচ্ছন্ন যোগাযোগ রয়েছে।
আসলে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা ভারতীয় যুব-মানসে জাতীয়তার বোধ উসকে দিয়েছিল। তাঁর সুযোগ্যা শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতাও এই জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে এক অনন্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। টেগার্টের রিপোর্টে এইসব তথ্যে সেগুলোর ব্যাপারে যে অভ্রান্ততা ছিল, এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। স্টিভেনশন মুর ছিলেন এবিষয়ে পথিকৃৎ। টেগার্ট তাঁর রিপোর্টের ভিত্তিতেই সমস্ত প্রতিবেদন রচনা করতেন।
রামকৃষ্ণ মিশন নিয়ে তাঁদের রিপোর্ট দেখে আমি বিস্মিত হয়ে যাই এই কারণে যে, তাতে ঠাকুরের জীবন, বাণী, ম্যাক্স মূলারের সমস্ত লেখা থেকে তাঁদের সম্পর্কে যে-ধারণা, বেলুড় মঠ এবং মঠের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, স্বামীজীর ১৮৯৪-৯৫ সালে ডেট্রয়েট, বোস্টন, হার্ভার্ড, শিকাগো পরিভ্রমণের সমস্ত রিপোর্ট এবং যেসমস্ত বিদেশি পুরুষ ও নারী সেখানে যোগ দিয়েছেন তাঁদের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করা, ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের ভূমিকাটা ঠিক কী সেটা বারবার করে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে সেইসব রিপোর্টে। এছাড়া ভগিনী নিবেদিতার মূল রচনা থেকে কীভাবে তিনি সরাসরি বিপ্লবী দলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন ইত্যাদি তথ্যও কিন্তু সেখানে রয়েছে। বিপ্লবী নায়ক হেমচন্দ্র ঘোষের যে-সাক্ষাৎকার স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন তাতে হেমচন্দ্র ঘোষ বলেছেন—স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বিপ্লবী চেতনা বিকাশে বিশেষভাবে সাহায্য করেছেন। হেমচন্দ্রের ভাষায়—বিবেকানন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতি কেউ কখনো ভুলতে পারে না। তাঁর পক্ষেও সেটা ভোলা সম্ভব নয়। কেননা, স্বামীজী ছিলেন তাঁর জীবনের এক সঞ্জীবনী শক্তি।
এসমস্ত ঘটনা থেকে সবশেষে বলা যায় যে, টেগার্ট বা ব্রিটিশ গোয়েন্দারাও কোনোভাবে রামকৃষ্ণ মিশনকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেননি।
স্বামীজী সরাসরিভাবে রাজনীতিতে যুক্ত না হলেও তিনি ভারতের এই জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সনাতন হিন্দুধর্মের প্রেরণাপ্রদ শক্তির সঙ্গে যে প্রগাঢ়ভাবে যুক্ত করেছেন এবং তাতে যে একটা বিরাট অংশের মানুষ উজ্জীবিত হচ্ছে—একথা কিন্তু বারবার ব্রিটিশের গোয়েন্দা রিপোর্টে এসেছে। আজ এত বছর পর ২০২২ সালে এসে আমার দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, আজ ভারতের ভবিষ্যৎ যদি সুষ্ঠু পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে তা সম্ভব হতে পারে মানবজীবনে বেদান্তের প্রয়োগ সম্বন্ধে বিবেকানন্দ যে-পরিকল্পনা করেছিলেন তার সফল প্রয়োগের মাধ্যমে।
তথ্যসূত্র
১ স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০১২, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ২১০
২ স্বামী বিবেকানন্দ, পত্রাবলী, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০২২, পৃঃ ৪২১
৩ বাণী ও রচনা, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ১৯৪
৪ পত্রাবলী, পৃঃ ১২০