পূজনীয় কালীকৃষ্ণ মহারাজকে [স্বামী বিরজানন্দকে] গুরুবৎ মনে হইত। যখন তাঁহাকে প্রণাম করিতাম, মনে হইত আমি আমার গুরুদেবকেই প্রণাম করিতেছি। উভয়ের মধ্যে সৌসাদৃশ্য ছিল। এইজন্যই কি তাঁহাকে গুরু মনে হইত? গাম্ভীর্য, শান্তভাব, সুমিষ্টভাষণ ও সেবা—এই কয়েকটি উভয়েরই সাধারণ ভূমি, উভয়েরই অতিমাত্র এই সম্পদগুলি ছিল।

কালীকৃষ্ণ মহারাজ তাঁহার যৌবনে, সাধু হইবার অব্যবহিত পূর্বে আমাদের গুরুদেবকে অনেক দিন সেবা করিয়াছিলেন। তাঁহার সেবায় মুগ্ধ হইয়া গুরুদেব বলিয়াছিলেন : “এই ছেলেটা কে রে? এ যে মায়ের মতো সেবা করে!” কালীকৃষ্ণ মহারাজ দীর্ঘকাল একাই স্বামীজী ও হরি মহারাজের রোগ-সেবা করিয়াছিলেন। সারাদিনে রাত্রির মধ্যে অত্যল্প সময় ইজিচেয়ারে ঘুমাইয়া লইতেন। দুইজন মহাপুরুষকে সেবা করা একসঙ্গে—বিশেষত কঠিন রোগের সেবা—এক অসামান্য ‌ক্ষমতা ও হৃদয়বত্তার পরিচায়ক। প্রায় ছয়মাস তিনি আদৌ ঘুমান নাই জানিয়া হরি মহারাজ স্বামীজীকে বলিয়া দেন। স্বামীজী রাগ করিয়া বলেন : “যা তোকে আর সেবা করিতে হইবে না।” কালীকৃষ্ণ মহারাজ মহাদুঃখিত। কাতর হইয়া পুনঃপুন আর্তি প্রকাশ—“আমার কোনো কষ্ট হইতেছে না। অনিদ্রার জন্য শরীর সামান্যও ক্লান্ত নহে—আমাকে এ সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত করিবেন না।” ইত্যাদি।

ইঁহার শরীর-মন সাধারণের শরীর মন হইতে যেন পৃথক ধাতুতে গঠিত। নতুবা কিছুতেই হেলিত না কেন? গোপালের মার উক্তি—‘বেজার নাই’ (বেজার নাই, অর্থাৎ কিছুতেই ইহার শান্তিভঙ্গ হয় না, বিরক্তি নাই)—স্বামী বিরজানন্দের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

কালীকৃষ্ণ মহারাজ বলিতেছেন: “আমার তিনটি মা ছিলেন—মা ঠাকুরানী, মিসেস সেভিয়ার (ইংরেজ কাপ্তান সেভিয়ারের পত্নী) এবং গর্ভধারিণী। হায়, একে একে ইঁহারা সকলেই চলিয়া গেলেন!” যতদিন গর্ভধারিণী জীবিত ছিলেন, প্রতি বৎসর তাঁহাকে দর্শন করিতে তিনি বৃন্দাবন যাইতেন। মা (সারদাদেবী) কোনো সময়ে মহারাজকে কয়েকটি (কেহ বলেন ছয়টি) বীজমন্ত্র শিখাইয়া বলেন : “ইহা তোমার কাজে লাগিবে।” প্রেসিডেন্ট হইয়া মহারাজ কিছুকাল দী‌ক্ষাদি দেন নাই। হয়তো মায়ের ইঙ্গিতের অপে‌ক্ষা করিয়াছিলেন। বাল্যকাল হইতেই লোকচ‌ক্ষুর অন্তরালে থাকিতে তৎপর মহারাজকে কোনোদিন দী‌ক্ষাদি দিতে হইতে পারে—ইহা তিনি কল্পনা করিতে পারিতেন না।

বিরজানন্দজী স্বামীজীর খুব স্নেহ ও বিশ্বাসের পাত্র ছিলেন। স্বামীজীকে তিনি খুব ভয়ও করিতেন। বিরজানন্দজী বলিয়াছিলেন : “একদিন চা তৈরি করিয়া চা-পূর্ণ কাপ একখানি সসারের (ডিস) উপর রাখিয়া স্বামীজীর নিকট উপস্থিত করিতেছি। তাঁহার সন্নিকটে আসিবামাত্র এত ভয় হইল যে, শরীর কাঁপিয়া উঠিল এবং হাত হইতে কাপ ও ডিস মাটিতে পড়িয়া গেল! সব চুরমার! অন্য কেহ এইরূপ করিলে কী হইত জানি না, কিন্তু স্বামীজী এই ব্যাপারে আমার প্রতি সামান্য ক্রোধ বা বিরক্তির ভাবও প্রকাশ করিলেন না। কেবল বলিলেন, ‘টুকরাগুলি কুড়াইয়া ফেলিয়া দে—নতুবা কাহারও পা কাটিতে পারে।’”

স্বামীজী পাশ্চাত্যদেশের শিষ্য-শিষ্যাসহ মায়াবতী আসিতেছেন। দুইদিন দুইরাত্রি অবিশ্রান্ত হাঁটিয়া কালীকৃষ্ণ মহারাজ মায়াবতী হইতে ৬৫ মাইল দূরে অবস্থিত স্টেশনে উপস্থিত হইয়া ঠিক সময়ে উহাদিগকে মায়াবতী লইয়া গেলেন। ৪৮ ঘণ্টা বরফাবৃত পার্বত্যপথ সমানে হাঁটিয়া আসা এক অতি কঠিন ব্যাপার! স্বামীজী অত্যন্ত প্রসন্ন হইয়া বলিয়াছিলেন : “কালীকৃষ্ণর মতো কতকগুলি লোক পাইলে আমি ভারতবর্ষ স্বাধীন করিতে পারি।”

কালীকৃষ্ণ মহারাজ স্বামীজীর সেবায় নিযুক্ত—খাবার তৈয়ারি করিতেছেন। দেরি হইতেছে বলিয়া স্বামীজী অস্থির হইয়াছেন। কালীকৃষ্ণ মহারাজকে খুঁজিতেছেন—দেখিলেন তিনি সিঁড়ির নিচে রান্না করিতেছেন। কাঠ ধরিতেছে না, একটু ধরিয়া নিভিয়া যাইতেছে—ধূমাচ্ছন্ন; ফুঁ দিতে দিতে মহারাজের মুখমণ্ডল আরক্তিম হইয়াছে। ইহা দেখিয়া স্বামীজী গাঢ় আলিঙ্গনের দ্বারা মহারাজকে মুগ্ধ ও কৃতার্থ করিয়া বলিলেন : “তুই এত কষ্ট করিতেছিস, আর আমি তোর প্রতি রুষ্ট হইতেছি!”

স্বামীজী শিষ্য ও গুরুভ্রাতাদিগকে কর্মযোগী হইবার জন্য খুব উৎসাহিত করিতেন। পাশ্চাত্যদেশ হইতে ফিরিয়া আসিয়া লোকহিতকর কর্মের দিকে তাঁহার খুব ঝোঁক হইয়াছিল। অনেক তর্কযুক্তি সত্ত্বেও কালীকৃষ্ণ মহারাজকে স্বামীজী লোকহিতকর কর্মে (রোগীর সেবা, দুর্ভি‌ক্ষ‌ ও বন্যাজনিত ক্লেশ নিবারণ) প্রবৃত্ত করিতে পারিতেছেন না। তিনি ঈশ্বরদর্শনের জন্য ধ্যান-জপ, তপস্যাকেই প্রধান এবং শ্রেষ্ঠ অবলম্বন মনে করিতেছেন। অবশেষে স্বামীজী বলিলেন : কালীকৃষ্ণ ঠিকই বলিয়াছে। After all Kalikrishna is right. [Life of Swami Vivekananda]

তবে ইহাও দেখা যায়, মায়াবতী আশ্রম পরিচালনা, ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ সম্পাদনা ও প্রচার এবং পরবর্তিকালে রামকৃষ্ণ মিশনের সেক্রেটারির কার্য তিনি অতীব সুচারুরূপে সম্পন্ন করিয়াছিলেন।

মহারাজকে যখন ঠাকুরপূজা বা অন্য পূজা করিতে হইত, তখন এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিত! তিনি আসনে বসিয়াই ধ্যানস্থ হইয়া পড়িতেন! কে আর পূজা করে! যখন ধ্যানভঙ্গ হইত, তখন অনেক সময় গত হইয়া গিয়াছে—কী আর করেন! সমস্ত পুষ্প-বিল্বপত্রাদি দুইহাতে মুঠি মুঠি করিয়া দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করিয়া পূজা সমাপন করিতেন। পূজাদির অন্তে একটা আবেশের ভাব থাকিত; সে-কারণে পাছে পড়িয়া না যান, এজন্য সেই কালে লোক তাঁহার নিকটে থাকিত।

ঠাকুরের তিরোভাবের অল্প পরেই কালীকৃষ্ণ মহারাজ তৎকালীন মঠে যাতায়াত করিতে আরম্ভ করেন এবং ঠাকুরের সন্তানদিগের সহিত ঘনিষ্ঠতা হয়। এজন্য ঠাকুরের প্রভাব তাঁহার সন্তানদিগের ন্যায়ই প্রায় তিনি অনুভব করিতেন এবং কখনো কখনো বলিয়াছেনও : “আমি তো ঠাকুরেরই পার্ষদ।”

তিনি খুব দীর্ঘকাল বহুসংখ্যক জপ করিতেন। একবার তাঁহার মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়, কলিকাতায় যান এবং স্বামী ব্রহ্মানন্দজী তাঁহাকে চিকিৎসাদিও করান কিন্তু ফল হয় না। তদনন্তর মা ঠাকুরানির নিকট গেলে সব শুনিয়া মা বলিলেন : “জপধ্যান করা ঠিক হইতেছে না, এজন্যই ঐরূপ যন্ত্রণা।” মা একটু হেরফের করিয়া দিলেন, তাহাতেই যন্ত্রণা দূর হইল।

মিষ্টভাষণ ও অক্রোধ কালীকৃষ্ণ মহারাজের স্বরূপ বলিলেও চলে। মোরাদাবাদে ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ প্রচারের জন্য গিয়াছেন। একটি তরুণ পসারি-‌উকিলের সহিত সা‌ক্ষাৎ করিয়াছেন। উকিলটি তরুণ ও বুদ্ধিমান। কালীকৃষ্ণ মহারাজকে এইসকল কার্য হইতে নিবৃত্ত হইয়া জীবনধারণের জন্য অর্থকরী কার্য ও বিদ্যা গ্রহণের জন্য বলিতেছেন। উকিলটির ব্যবহার অতি অভদ্র, বাক্যগুলিতে সৌজন্য নাই, কঠোর ও নির্দয় বাণী—অনেক‌ক্ষণ এইরূপ ভর্ৎসনা সত্ত্বেও মহারাজ কিছুই বিতর্ক না করিয়া অতীব শান্ত
ও প্রসন্নচিত্তে বিদায় গ্রহণ করিলেন। উকিলটি পরে অত্যন্ত অনুতপ্ত হইয়াছিলেন—সন্ন্যাসীর সহিত এরূপ রূঢ় ব্যবহার করিয়াছেন বুঝিয়া তাঁহার শারীরিক ও মানসিক অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ হইতে লাগিল। পত্রাদি দ্বারা যখন জানিতে পারিলেন যে, সাধুটি তাঁহার প্রতি আদৌ বিরূপ হন নাই, তখন শান্তি পাইলেন।

যাঁহারা কালীকৃষ্ণ মহারাজের সহিত খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট সাধুকে বলিতে শুনিয়াছি—“মহারাজকে কখনো ক্রুদ্ধ হইতে দেখা যাইত না।” রামকৃষ্ণ মিশনে সেক্রেটারির পদ এক বৃহৎ ব্যাপার। এখানেই তিনি সর্বদা সুশান্ত থাকিতেন। সকল কোলাহলের মধ্যে মেজাজ ঠিক রাখা এক অসামান্য দৈবী সম্পদ।

উপনিষদে ‘ধীর’ শব্দটির বহুল প্রয়োগ দৃষ্ট হয়। মহারাজের জীবনে ‘ধীরতা’ স্বাভাবিক হইয়াছিল।

গুরুর জীবনের অনুরূপ জীবন যদি শিষ্যের হয় তবেই গুরুভক্তি ঠিক বুঝিতে হইবে। নতুবা গুরুর অন্তর্ধানের পর সকল শোক-দুঃখই বৃথা। ইঁহারা বাহিরের সাজসজ্জা, শি‌ক্ষাদী‌ক্ষা দেখিতেন না। অনুভবের দিকেই দেখিতেন। একটি হিন্দুস্থানি বালক-ভৃত্য, বয়স ১৪/১৫ কিংবা আরো কম হইবে, মহারাজের নিকট দী‌ক্ষাপ্রার্থী। দুই-চার বার প্রতিনিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিয়াও তাহার দৃঢ়তা দেখিয়া যে-সাধুটি দী‌ক্ষার্থীদের পরিচয়াদি সংগ্রহ করিতেছেন, তাঁহার নিকট অনুরোধ করিলাম। তিনি স্বয়ং অনিচ্ছুক না হইলেও বৃদ্ধ সাধুরা অল্পবয়স্ক অতি নিম্নশ্রেণির ভৃত্যকে দী‌ক্ষাদানকার্যটি অনুমোদন করিবেন না—এই আশঙ্কায় ইতস্তত করিতেছেন। এই সময় কালীকৃষ্ণ মহারাজ আসিয়া পড়িয়াছেন এবং লোকজনের ভিড় একটু কমিলে বিশ্রাম করিতেছেন। তখন পূর্বোক্ত সাধুটি আমাকে ল‌ক্ষ্য করিয়া মহারাজকে বলিলেন : “ইঁহার চাকরটি লেখাপড়া কিছু কিছু করে, কিন্তু স্বল্পবয়স্ক, দী‌ক্ষা লইতে চায়।” তখন মহারাজ সুপ্রসন্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন : “ছেলেটির আগ্রহ আছে কি?” আমি বলিলাম : “মহারাজ, খুব আগ্রহ আছে—ছেলেটি সরলও বটে।” তদুত্তরে তৎ‌ক্ষণাৎ মহারাজ বলিলেন : “আগ্রহ যখন আছে, তা বেশ।” অন্য মাননীয় ব্যক্তিদের সহিত ছেলেটির যথারীতি দী‌ক্ষা হইয়া গেল। এবং আশ্চর্য, তাহার ঝোঁক অনুযায়ী কৃষ্ণমন্ত্রে তাহাকে দী‌ক্ষা দিলেন!

একটি ৪০/৪১ বৎসরের মহিলার দুই-তিন মাসের মধ্যে স্বামিসহ চারটি পুত্র-কন্যার মৃত্যু হওয়ায় সে নিঃশেষে অনাথা হইল। তাহার আর কেহই রহিল না। মেয়েটি আমার আত্মীয়া। তাহাকে দী‌ক্ষার জন্য দেরাদুন পাঠানো হইল। মহারাজের সেবক মহারাজকে তাহার দুঃখের কাহিনি পূর্বেই বলিয়া রাখিয়াছিলাম। মহারাজ আলাদা করিয়া তাহার সব কথা শুনিয়া পৃথগ্‌ভাবে দী‌ক্ষিত করিলেন এবং সে কত যে উৎসাহ পাইল তাহা বলিবার নহে। এই মেয়ে পরে অন্তত দুইবার এক কঠিন রোগীর আসন্ন মৃত্যুকালে শুশ্রূষার সময় মহারাজের সা‌ক্ষাৎ দর্শন পাইয়া হতভম্ব হইয়া যায়, সাহস পায় এবং রোগীর যথোচিত ব্যবস্থাও সম্ভব হয়। উক্ত মহিলা নার্স ছিল।

পূজনীয় কেদারবাবার [স্বামী অচলানন্দ] মৃত্যুসংবাদ মঠে পৌঁছাইবার পূর্বেই কালীকৃষ্ণ মহারাজ তাঁহার শরীরত্যাগ হইয়াছে জানিতে পারেন এবং কয়েকদিন অত্যন্ত কষ্টানুভব করেন। পূজনীয় কেদারবাবার তাঁহার প্রতি সুগভীর ভক্তি ছিল—গুরুবৎ গুরুভাইকে মান্য দিতেন, পুষ্পাদি পদদ্বয়ে রাখিয়া দণ্ডবৎ হইতেন। অত্যন্ত আর্তি লইয়া সর্বদা অসুস্থ কেদারবাবা মহারাজের নিকট একদিন বলেন : “আশীর্বাদ করিবেন, আপনার বর্তমানেই যেন আমার দেহান্ত হয়—শরীরের কষ্ট আর সহ্য হয় না।”

স্বামীজী কালীকৃষ্ণ মহারাজকে প্রচারকার্যে ঢাকা পাঠাইবেন। মহারাজ নারাজ—“আমার দ্বারা প্রচার সুচারুরূপে হইবে না। আমার শক্তি নাই।” অতঃপর স্বামীজী মহারাজের একটি আঙুল নিজহস্তে ধরিয়া উহা আপনার ব‌ক্ষস্থলে স্পর্শ করাইলেন। কত‌কক্ষণ এইভাবে গেল। মহারাজ সংজ্ঞাশূন্যের ন্যায় হইয়া গেলেন। তদনন্তর স্বামীজী বলিলেন : “এখন বল, প্রচার করিতে পারবি কি না।”

মহারাজ বলিতেন : “এই ব্যাপারে আমার বোধ হইল, দৃঢ় বিশ্বাস হইল—আমি সব করিতে সমর্থ।” শোনা যায়, মহারাজের ঢাকায় প্রচারকার্য খুব সুন্দর ও কার্যকর হইয়াছিল। সংঘের জন্য তিনি সব করিতে প্রস্তুত ছিলেন। এতই তিনি সংঘকে আপনবোধ করিয়াছেন।

গুরু শিষ্যের রুচি অনুযায়ী দী‌ক্ষা দিতে সমর্থ কি না শিষ্য পরী‌ক্ষা করিয়াছে। শিষ্যের গলায় সস্নেহে হাত রাখিয়া মহারাজ বলিলেন : “এই না তোর ইষ্ট?” শিষ্য তৃপ্ত হইল। শেষের দিকে অসুস্থতাবশত তিনি ঠাকুরের নাম ছাড়া অন্য মন্ত্র প্রায়ই দিতেন না। এক শিষ্যের মাতার দী‌ক্ষার ইচ্ছা। তিনি কৃষ্ণভাবে ভাবিতা। সেবক বলিলেন, এখন হইবে না। যাহা হউক, মহারাজ ইহা শুনিয়া সেবককে বলিলেন, “আচ্ছা, আসিতে দাও।” তখন সেবক বলিলেন : “মহারাজ, এইরূপ আট-দশজনকে আমি ফিরাইয়া দিয়াছি, তাহাদেরও কি আসিতে বলিব?”— “নিশ্চয়, বল।”

দী‌ক্ষাদির সময় খুব পরিশ্রম হইত নিঃসন্দেহ। দীর্ঘকাল ধরিয়া দী‌ক্ষাদান—কখনো পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী। কিন্তু কী ধীর স্থির! সামান্য হেলদোলও নাই। শরীর বেশি অসুস্থ হইবে বোধে কর্তৃপ‌ক্ষীয়রা দী‌ক্ষাদান বন্ধ করিলে মহারাজ দুঃখিত হইতেন। বলিলেন : “আমি এই দী‌ক্ষা দিবার কালে খুব ভাল বোধ করি—কোনো কষ্টবোধই হয় না। কেন ইহারা দী‌ক্ষাকার্য বন্ধ করিতেছে?” তাঁহার শিষ্যসংখ্যা দশ হাজারের মতো হইয়াছিল।

মহারাজ একবার দেরাদুন যাইতেছেন—কলিকাতা হইতে। বেনারস ক্যান্টনমেন্টে গাড়ি থামিবে, তাঁহাকে কাশীতে দুই-চার দিন থাকিবার জন্য মহারাজেরা খুব আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁহার শরীর তখন সুস্থ নহে। দী‌ক্ষাদান ও বেশি কথাবার্তা বলা নিষেধ। একজন পণ্ডিত সাধু বলেন : “মহারাজ, আপনি নামুন এখানে। আমি এমন বন্দোবস্ত করিব, যাহাতে একটি লোকও আপনার নিকট যাইতে পারিবে না।” মহারাজ—“বল কী? লোককে উপদেশ দেওয়া, দী‌ক্ষা দেওয়া যদি বন্ধ থাকে তবে আমার আর কী প্রয়োজন থাকিতে পারে? নামিবারই বা কী দরকার!” এতই তাঁহার লোকানুগ্রহের ঝোঁক ও প্রবৃত্তি! তিনি নামিলেন না। সোজা দেরাদুন চলিয়া গেলেন।

জীবনান্ত হইবার শেষদিকে প্রত্যহই সম্মুখে প্রসিদ্ধ ডাক্তার উপস্থিত। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন : “মহারাজ, কেমন আছেন?” মহারাজ তৎ‌ক্ষণাৎ বলিলেন : “ভাল আছি।” ডাক্তার বিরক্তই হইলেন। Broadcast করিতে হইবে। সেবক ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করিলেন : “কী রিপোর্ট দিব?” ডাক্তার একটু রু‌ক্ষভাবে বলিলেন : “লিখুন তিনি ভাল আছেন।” সেবক—“একথা বলিতেছেন যে!” ডাক্তার অপ্রতিভ হইলেন, বলিলেন : “এ রোগী দুর্বোধ্য। রোগল‌ক্ষণ পরী‌ক্ষা করিয়া রিপোর্ট দিতে হইলে বলিতেই হয় যে, ইনি এখনো বাঁচিয়া আছেন! এ একটা অদ্ভুত ঘটনা (miracle)!”

বস্তুত, নিজের কোনো অসুবিধা কোনোদিনই ইনি কাহাকেও জানিতে দিতেন না। হয়তো সাধারণের যাহাতে অসুবিধা হয়, তাহাতে তাঁহার অসুবিধা হইত না। হয়তো বা তিনি সর্বাবস্থাতেই নিজেকে সুস্থ মনে করিতেন। হয়তো কাহাকেও উদ্বিগ্ন করিতে চাহিতেন না।

রোগগ্রস্ত অবস্থায় শৌচাদির জন্য হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গ হইলে মহারাজ আলো জ্বালিয়া যদি দেখিতেন সেবক নিদ্রিত, তাহা হইলে নিঃশব্দে জুতার শব্দ যাহাতে না হয়, সেজন্য জুতা হাতে লইয়া শৌচগৃহে যাইতেন। সেবক একটু ঘুমাইতেছে, নিদ্রাভঙ্গ হইলে তাহার কষ্ট হইবে।

সেবকেরা পরিশ্রম করে কিন্তু কেহই যত্ন করিয়া তাহাদের আহারাদির উপর দৃষ্টি দেয় না—এজন্য মহারাজ দুঃখিত হইতেন। লোকজন চলিয়া গেলে দরজা বন্ধ করিয়া উত্তম উত্তম খাবার দেখাইয়া বলিতেন : “তোরা যত পারিস খাইয়া নে।”

একটি ছোকরা শিষ্য ব্রহ্মচারী বলেন : “মহারাজের বুকের মধ্যে আমার মাথাটা রাখি এবং মহারাজ আমাকে ঐ অবস্থায় একটু আদর করুন—এই ইচ্ছা আমার বড়ই প্রবল হইয়াছিল, কিন্তু মুখ ফুটিয়া বলিতে পারি নাই অনেকদিন। যাহা হউক, একদিন বলিয়া ফেলিলাম। মহারাজ হাসিয়া বলিলেন, ‘সে আর কী বেশি কথা!’ অতঃপর আমার মাথা টানিয়া বুকের মধ্যে রাখিলেন এবং নানাভাবে পিঠে, মাথায় হাত বুলাইয়া দিলেন। আমি কৃতার্থ হইলাম।”

একটি অল্পবয়স্ক ডাক্তার-সাধুকে দেখিয়া মহারাজ একদিন বড়ই আনন্দিত হইলেন এবং গলায় ঔষধ লাগাইতে বলিলেন—“দেখ, ওরা কীভাবে ঔষধ লাগাইতে হয় জানে না। তুমি আসিয়াছ, আমার আর কোনো উদ্বেগ রহিল না।” সাধুটি ঔষধ লাগাইয়া দিলে কী যে আহ্লাদিত হইলেন তাহা বলিবার নহে! যেন ঠিক জিনিসটি এতদিন পান নাই, এখন পাইলেন! সেবা হইবে ‘correct & quick’ অর্থাৎ নিখুঁত এবং দ্রুত—ইহাই ছিল তাঁহার সেবার আদর্শ। এরূপ না হইলে তিনি বিরক্ত হইতেন। সেবা প্রসঙ্গে ‘correct & quick’ বিশেষণদ্বয় তাঁহারই বলা। [ক্রমশ]